লাট্টু ঘোরানো মোটে সহজ ব্যাপার না। সেই ছোট্টবেলায় রথের মেলা থেকে বাবা কিনে এনেছিল লাল রঙের কাঠের লাট্টুটা। লেত্তি জড়িয়ে ঘোরানোর কত চেষ্টা। কিছুতেই ঘোরে না। কাত হয়ে পড়ে থাকে। অথচ পাড়ার ছেলেরা ওই লাট্টুটা নিয়ে ভেলকি দেখায়। কখনও হাতের তালুতে স্থির, কখনো বা বাঁই বাঁই ঘুরছে চক্রাকারে। অথচ আমার বেলা…
আরও পড়ুন
গোলাপি সাইকেল ও রঙিন ছেলেবেলার নব্বই
আরো ক'বছর এগিয়ে, ক্লাস সেভেনের আমি নতুন খেলনা পেয়ে মশগুল। বাজারে এসেছে 'বে-ব্লেড'। এও লাট্টু। তবে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। লেত্তির দরকার নেই। রয়েছে 'লঞ্চার' আর 'রিপ-কর্ড'। লঞ্চারে বসিয়ে, 'রিপ-কর্ড' টানলে বে-ব্লেড ঘুরবে দারুণ জোরে। বিভিন্ন অংশ খুলে ফেলে, অন্য মেক-ওভার দেওয়া যাবে এই অভিনব খেলনাটিতে। খেলনাটাকে কেন্দ্র করে কার্টুন নেটওয়ার্ক-এ এসেছে টিভি শো। স্কুল থেকে ফিরেই গোগ্রাসে গিলি সেই কার্টুন। তারপর নিজের বে-ব্লেড সঙ্গে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বেরোই। ক্রিকেট-ফুটবল মাথায় উঠেছে, সবার হাতে লাট্টু। লড়াই জমে উঠেছে। গোত্তা মেরে আমার বে-ব্লেড, প্রতিপক্ষকে উড়িয়ে দিচ্ছে। কখনো অসাবধানতাবশত হেরে যাচ্ছি। চেঁচামেচি-ঝগড়া-মারপিট। মাঝেমধ্যেই বাড়ির রান্নাঘর থেকে উধাও হয়ে যায় হাঁড়ি-কড়া। সিরিয়াস কম্পিটিশন হচ্ছে, 'স্টেডিয়াম' লাগবে তো! বে-ব্লেড ঘুরবে কোথায়? মাটিতে ফেললে নষ্ট হয়ে যাবে যে…
২০০৬-০৭ সালেও, কলকাতায় বে-ব্লেডের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। মফঃস্বলের কচি-কাঁচাদের হাতেও লাট্টু… হুজুগ চলেছিল ২০০৮-০৯ অবধি।
আরও পড়ুন
মায়াবী সুর ও টমবয় পপস্টারের অ্যালবাম
জাপানের গ্রামে গঞ্জে কচিকাঁচাদের মধ্যে লাট্টুর লড়াই লেগে থাকে। এই বিশেষ লাট্টুকে বলা হয়, 'বেইগোমা'। তার আদলেই, সে দেশের দুটি বিখ্যাত খেলনা কোম্পানি, 'তাকারা' ও 'তোমি'র যৌথ প্রয়াসে তৈরি হল বে-ব্লেড। ১৯৯৯ সালে। খেলনা 'লঞ্চ' হওয়ার পাশাপাশি বেরোল কমিকস। জাপানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে মার্কিন কোম্পানি 'হ্যাসব্রো' বে-ব্লেডকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেয়। টিভি তোকিও'র প্রয়োজনায় টিভির পর্দায় চলে এল সিরিজ 'বে-ব্লেড'। বিশ্বায়নের প্রজন্ম নতুন মোড়কে আপন করে নিল 'পুরাতনী' লাট্টুকে।
আরও পড়ুন
কার্টুন আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে হানা দিল পুলিশ
তবে একটা খেলনাকে ঘিরে এত পাগলামির মূলে 'বিট-বিস্ট'। 'বিট-বিস্ট' হল লাট্টুর মধ্যে বাসা বাঁধা আত্মা। গাঁজাখুরি শোনালেও, এরাই আদতে নির্ধারণ করে হার-জিত। 'অচলাবস্থায়' ঘুমিয়ে থাকে বে-ব্লেডের ঠিক মাঝখানে। 'বিট-চিপে'। লাট্টুতে-লাট্টুতে টক্কর লাগলে, নখদন্ত বিকশিত করে ঝাঁপায় শত্রুর দিকে। বিভিন্ন রূপ বিট-বিস্ট'দের। কেউ ড্রাগন, কেউ বাঘ, কেউ আবার পাখি। নানা অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী তারা। লড়াই চলাকালীন স্টেডিয়ামে ঝড় ওঠে, কখনো বা ছড়িয়ে পড়ে আগুনের ফুলকি। তবে এসব ভেলকি এক 'কার্টুন নেটওয়ার্ক' ছাড়া আর বাস্তবে কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না। কিন্ত বিশ্বাস করতে দোষ কোথায়? কল্পনার মিশেলে তৈরি এক অভূতপূর্ব মার্কেটিং স্ট্রাটেজি। জড়বস্তুর মধ্যে প্রাণের আভাস, খেলনাকে আর খেলনার পর্যায়ে ফেলে রাখেনি।
আরও পড়ুন
৮০ বছর অতিক্রান্ত, নির্বাক হয়েও আজও ‘নতুন’ টম অ্যান্ড জেরি
বে-ব্লেড ঘিরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য টিভিসিরিজ-কমিক্স-সিনেমা। মূল চারজন চরিত্র, টাইসন, ম্যাক্স, রে ও কাইকে নিয়েই তিনটি সিরিজ। প্রথম সিরিজ তাদের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার গপ্পোকে কেন্দ্র করে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় যথাক্রমে অভ্যন্তরীণ মনোমালিন্য এবং একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কেন্দ্র করে…
ভারতে বে-ব্লেডের বাজার, টি-আর-পি পড়তে শুরু করে ২০০৮ সাল থেকে। কচিকাঁচাদের তখন হাতে হাই-স্পিড ইন্টারনেট। ইচ্ছেমতো ইউটিউব ঘেঁটে এপিসোড দেখা যায়। হারিয়ে গিয়েছে অপেক্ষা, চমকের মজা। খেলনা সম্পর্কে আকর্ষণও কমছে ধীরে ধীরে।
আরও পড়ুন
স্পাইডারম্যান হোক বা হাল্ক – শৈশবের ‘সুপারহিরো’দের জন্ম দিয়েছিলেন যিনি
২০০৯-১০ নাগাদ খেলনার দোকান, ফুটপাথ থেকে বে-ব্লেডের বিক্রি কমে আসছিল। এখনো খুঁজলে কয়েক পিস দেখা যাবে হয়তো, শোকেসে। ধূলিধূসরিত।
রংচটা লাট্টুর ওপর সযত্নে হাত বোলালে বুঝি, ছোটবেলাটা শেষ হয়ে গেল বড়ো তাড়াতাড়ি…