(দ্বিতীয় পর্ব)
আজ, ২০২০ সালে, অনেকেই হয়তো বিনা তর্কে মেনে নেবেন, পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি পোড়ো জমি হয়ে গেছে। এই ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ হয়ে ওঠার সম্ভাব্য ব্যাখ্যাটি আমাদের কিছুটা জানা, কিছুটা আন্দাজ করা যায়। তা হলেও, সেই ছেদবিন্দুটি আসলে কী - যখন শেষ ভালো কাজটি হয়েছিল এবং কবে থেকেই বা তা হওয়া একরকম বন্ধ হয়ে গেল! সময়েরও আছে পথ এবং এই পথে আমাদের অন্যতম শেষ চিহ্ন - ‘পাতালঘর’।
২০০৩ সালে ছবিটি মুক্তি ও জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল, পাশাপাশি কিছু শংসাও। আমাদের বিস্মরণ ক্ষমতা অতি জোরালো ও দ্রুত - ছবিটিকে নিয়ে আমরা তেমন কিছু লিখিনি, হয়তো ভাবিওনি।
‘পাতালঘর’ আমাদের বাংলা সংস্কৃতির পক্ষে অত্যন্ত জরুরি কিছু স্মৃতিকে আর্কাইভ করেছিল। এই স্মৃতি যে বিনষ্টিপ্রাপ্ত, এমন দ্যোতনাও ছিল। নয় দশকের বিশ্বব্যাপী পটবদল ও সাংস্কৃতিক ডিপ্রেশন বাঙালির মননকে পঙ্গু করে দিচ্ছে; যে-আসন্ন প্যারালিসিসকে বুঝতে পেরেছিল শিশুতোষ ছবিটি। স্বেচ্ছায় ‘পাতালঘর’ কিছু মৃত ইমেজ, মৃত সাউন্ড, মৃত চরিত্র ও মৃত প্রবণতার ভাঁড়ার ঘর কিংবা স্ট্যাকরুম হতে পেরেছিল। আমাদের স্মৃতিতে আজ বিস্তর ধুলো। কাজেই এই ছবিটিও ‘ভূত’ হয়ে গেছে, যেরকম ‘ভূত’ হয়ে গেছে আমাদের পুরোনো সংস্কৃতি।
আরও পড়ুন
‘শেষ পঞ্চাশ’ প্রথম পর্ব: দ্বাদশ ব্যক্তি
বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞান লেখার চল দীর্ঘদিনের। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর যুগ থেকে এই ধারা চলছে, অর্থাৎ বাংলা কল্পবিজ্ঞান জঁরের বয়স একশো বছর পেরিয়েছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই কল্পবিজ্ঞানের দুনিয়াতেই অসামান্য সংযোজন ঘটিয়েছিলেন; অতিখ্যাত ‘অদ্ভুতুড়ে সিরিজ’ - যতই বলা হোক ‘হাসি’র - আদতে কল্পবিজ্ঞান ও অকাল্ট জঁরের মিশেল। ‘অদ্ভুতুড়ে সিরিজে’র একটু আগেই কল্পবিজ্ঞান গল্প লিখেছেন সত্যজিৎ রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্র; হাসির অভাব তাদের গল্পে ছিল না। অদ্ভুতুড়ে সিরিজের মতো শঙ্কু বা ঘনাদা-কাহিনিও নানান জঁরের মিশেলে তৈরি করা; হাসি, সাসপেন্স, ভয় ও বিস্ময় মিশিয়ে লেখা। প্যারানর্মাল উপাদান যেমন তাতে আছে, থ্রিলেরও কমতি নেই, আবার তা একই সঙ্গে ঝলমলে বিস্ময়ে রঙিন - একেবারে বাঙালি কিছু মুদ্রাদোষ তাতে জায়গা নিয়েছে। ‘পাতালঘর’ ছবিটি এই অভ্যাসকে মনে রেখেছিল।
এবং তাই, ছবিতে আমরা ভীষণ সিরিয়াস কিছু মুহূর্তের পাশেই পাই অতি সহজ কিছু মুহূর্ত, হিমঠান্ডা ভয়ের সঙ্গে বুনে দেওয়া হয় অট্টহাসি। তা ক্রমেই হয়ে যায় লুপ্ত সংস্কৃতির নকশি কাঁথা –এক অর্থে, পাতালঘরই আমাদের সংস্কৃতিতে শেষ নস্টালজিক ছবি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘বিজ্ঞানী অঘোর’ চরিত্রটি শীর্ষেন্দুর কল্পিত হলেও এটি শঙ্কু চরিত্রের স্মৃতিও উস্কে দেয় - কখনও-বা পুরোনো ‘সন্দেশ’-এ সুকুমার রায়ের ইলাস্ট্রেশন জ্যান্ত হয়ে ওঠে। ইঁদুর ও ছুঁচো বেজায় উৎপাত করছে বলে পিসিমার জন্যে একটা ঘুমপাড়ানি যন্ত্র আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানী, যার কথা তিনি খাতায় লিখে যান - অনেকটা গুপ্তধনের সংকেত দেওয়ার মতো করে।
আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে
এই যন্ত্র থেকেই গোলমাল পাকিয়ে ওঠে। কাহিনির বীজ রয়েছে এই প্রাচীন তুলোট খাতায়, তার সংকেতে। নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানী ভূতনাথের হাতে এই খাতাটি এসেছে, তাকে ব্ল্যাকমেল করে এক গুপ্ত অস্ত্র-ব্যবসায়ী সংঘ গ্রামে আস্তানা গেড়েছে। ওদিকে বোকাসোকা মামা ও তার চালাক ভাগনে যে অঘোরের বাড়িতেই বাসিন্দা হয়ে এসেছে, আমরা টের পেয়েছি। বাকি গল্পও সবার মোটামুটি জানা।
ছবির প্রবণতাগুলি এবার দেখাতে চাইছি। ‘গুপ্তধন’ (অঘোরের যন্ত্র যেখানে আছে, সেই ‘পাতালঘর’)–এর সংকেত-ছড়াটি ছিল
আহ্লাদে আটখানা
সাতে পাঁচে নেই
মাঝখানে যেই জন
পথ পাবে সেই
শঙ্খে চক্রে আছে
পদে পদে ভর
পারিজাতে ভর করে
যা পাতালঘর।
আরও পড়ুন
জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে (দ্বিতীয় পর্ব)
এই ছড়া শীর্ষেন্দুর মূল গল্পে ছিল না, এটি চিত্রনাট্যকারের অবদান। এই ধরণের ছড়ার উৎস আমরা পাই সত্যজিৎ রায়ের ‘রয়াল বেঙ্গল রহস্য’ গল্পে -
মুড়ো হয় বুড়ো গাছ
হাত গোনো ভাত পাঁচ
দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে…
কিংবা ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গুপ্তধন’ গল্পের ছড়াটি -
পায়ে ধরে সাধা
রা নাহি দেয় রাধা
শেষে দিল রা…
আরও পড়ুন
“আমি চাই, আমার সিনেমা দর্শককে বিব্রত করুক, অস্বস্তিতে ফেলুক”— ইন্দ্রাশিস আচার্যর সঙ্গে একটি আড্ডা
‘পাতালঘর’ ছবিতে এরকম সাংস্কৃতিক প্রক্ষেপ আমরা আরো হরেক জায়গায় পেতে থাকব।
যেমন ধরা যাক বিগত ছায়াছবির কথা। মামা সুবুদ্ধির গাওয়া ‘যেকোনো ভূমিকায়’ গানটিতে উদ্ধৃত করা হয়েছে বাংলা স্বর্ণযুগের ছবিগুলিকে; ‘সন্ন্যাসী রাজা’র উত্তমকুমার, ‘চারুলতা’র মাধবী কিংবা ‘সপ্তপদী’র সুচিত্রা সেনের মিমিক্রি অকারণ নয়।
গুপ্ত সংঘের কোরাসে ‘অস্তর অস্তর’ গানটিও আসলে একটি মিথ-প্রতিম বাংলা ছবিকেই উদ্ধৃত করে; ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ সিনেমার ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ গানটিকে পুরোনো মদ হিসেবে নতুন বোতলে রাখা হয়েছে।
আরও পড়ুন
প্রোজেক্টরে সিনেমা দেখতে চায় না কেউ, অভাবের সঙ্গে লড়ছেন কলকাতার বায়োস্কোপওয়ালা
মনে পড়ছে কি ভিনগ্রহী ‘ভিক’-এর মহাকাশযানে কথা-বলা রোবট মুখটিকে? একই সঙ্গে ভাবুন ‘হীরক রাজার দেশে’র যন্তর মন্তর ঘরের মুখটির কথা। …অতি সহজ মিল!
অস্ত্র ব্যবসায়ী ভিলেন এখানে নিষ্ঠুর হলেও কমিক; রমাপ্রসাদ বণিক অভিনীত ‘টেক্কা’ চরিত্র ‘খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়োল’ ছড়া আওড়ান, যা আবারও সোনার কেল্লা থেকে সরাসরি তুলে আনা… মন্দার বোস তথা কামু মুখার্জি মুকুলকে কোলে নিয়ে ছড়াই বলবেন হিপনোটিজমের পরে।
এবং মাস্টার স্ট্রোক যেটি – ‘পাতালঘর’-এ গ্রামের নামও ‘নিশ্চিন্দিপুর’!
আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া রিল পুনরুদ্ধার, ৬৩ বছর পর ‘মুক্তি’ পাবে কিশোর কুমারের সিনেমা
পুরো বাংলা ছবির এভাবেই ইতিহাস ডাম্প হয়ে আছে এখানে।
ছবিটিতে চারটি কালার প্যালেট ব্যবহার করা হয়েছে; প্রয়োগটি অত্যন্ত সচেতন। গ্রামের সিকোয়েন্স-এ নরম হলুদ তুলোট কাগজের মতো আলো/ শাহরিক তথা অস্ত্র ব্যবসায়ী সিকোয়েন্স-এ ক্রূর ফ্যাকাশে নীল আলো/ ভিনগ্রহী ভিকের মহাকাশযান সিকোয়েন্স-এ অত্যাধুনিক নীল সবুজ আলো/ অঘোরের প্রেতায়িত সিকোয়েন্স বোঝাতে স্বপ্নময় গাঢ় নীল শাদা আলো।
এখানে হলুদ রঙ আর্কাইভের ইঙ্গিত আনে- যে গ্রাম আর থাকবে না, অথবা আর নেই, ফলে সেখানে ছেয়ে থাকে হলুদ তুলোট কাগজের আলো…।
আরও পড়ুন
বাস্তব, না-বাস্তব এবং ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’—এই সিনেমা দর্শককে মুগ্ধ করে, অস্বস্তিতেও ফেলে
গ্রামটা সত্যিই স্মৃতির গ্রাম, কারণ শূন্য দশকের শুরুর সময়ে এখানে সিরাজদৌল্লা নাটক হয়, নাটকের রিহার্সালে প্রবীণরা অংশ নেন, মুড়ি খাওয়া হয় একসঙ্গে, নাটক ভণ্ডুল হয়ে গেলে সর্বনাশও ঘটে… এখানে দুর্গাপুজো হয়, বাচ্চারা লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরবন্দি খেলে…
এই গ্রাম আদতে বাংলা সংস্কৃতির হ্যালুসিনেশন, তাই এই গ্রামের প্রান্তে থাকে নীলকুঠি (যেখানে ভিক-এর মহাকাশযান নেমেছিল), তাই এই গ্রামের নাম ‘পথের পাঁচালি’ থেকে সরাসরি তুলে নেওয়া হয়… আমাদের লুপ্ত স্মৃতিকে ছবিটা এভাবেই পড়তে শুরু করে।
চরিত্রশালা হিসেবেও এটি বাংলা শিশুতোষ সাহিত্যকে ক্রমাগত মনে পড়িয়ে যায়। বেগম, টেক্কা, ভিক, ভূতনাথ, অঘোর, পিসিমা, কালীসাধক ডাকাত, ভাগনে, মামা, অপয়া গোবিন্দ, রাগী প্রম্পটার, তোতলা সঞ্চালক, উকিল সাপুঁই… ঠিক একটা মিউজিয়ম যেন! (দ্রষ্টব্য, এই ট্যাপেস্ট্রি নির্মাণের চেষ্টা অনীক দত্ত পরিচালিত ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ সিনেমায় আরো একবার করা হবে।)
আরও পড়ুন
সত্তরের দশকেও হিন্দি-আধিপত্যে জর্জরিত ছিল কলকাতা, জানান দেয় ‘ধন্যি মেয়ে’র দৃশ্য
প্রতিটি দৃশ্য-সিকোয়েন্স এখানে অত্যন্ত পরিমিত, যারা বিদ্যুৎঝলকের মতোই মনে দাগ কেটে যায়। সেই যুগ আসন্ন যখন বাঙালির সংস্কৃতির আর কিছুই থাকবে না; তাই সন্ধ্যা ভাষায় তাদের সাংকেতিক ক’রে লুকিয়ে রাখা - প্রতিটা ইমেজ যত্নশীল ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখে দেওয়া তাই!
কোনো শিশু চাইলে এই পাতালঘর থেকে কৌতূহল বশে অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারে; পুরনো চার্ট, টেস্টটিউবের তরল, আবিষ্কারের খসড়া, অসমাপ্ত যন্ত্র… পুরোনো বাংলা সাহিত্য, পুরোনো বাংলা পেইন্টিং, পুরনো বাংলা ছায়াছবি, পুরোনো ইমেজ, পুরোনো সাউন্ড…
যেমন তার ভাই কার্তিককে বিজ্ঞানী ভূতনাথদা বলে গেছিল - ‘খুঁজলে তুই ঠিক পাবি’…।