বাংলায় পড়াশোনা ও চাকরির ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাক বাঙালিরাই– দাবি যুক্তিযুক্ত না অযৌক্তিক?

নিতান্ত উড়িয়ে দেওয়া যায় না এই দাবি। আবার, একশ্রেণির মানুষ বিরোধিতাও করছেন এর। বলছেন, এত প্রাদেশিকতা কেন! অথচ ইতিহাসে উঁকি দিলে দেখা যায়, বাঙালি ভারতবর্ষের সেই বিরল জাতিগুলির অন্যতম, যারা প্রাদেশিকতাকে প্রাধান্য দেয়নি বিশেষ। এর ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। বিভিন্ন জাতির মিশ্রণে যেমন পুষ্ট হয়েছে বাঙালি, তেমন সহজ হয়েছে অন্যদের সঙ্গে আদানপ্রদানও। কিন্তু এই উদারতাই কি কোথাও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কোথাও কোণঠাসা করে ফেলেছে? এমন কথা শোনা যায় মাঝেমধ্যেই। বিশেষত, ‘বাংলা পক্ষ’ নামের একটি সংগঠন নিয়মিত আন্দোলন করছেন ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন
সত্তরের দশকেও হিন্দি-আধিপত্যে জর্জরিত ছিল কলকাতা, জানান দেয় ‘ধন্যি মেয়ে’র দৃশ্য

গত কয়েকদিনে এমন কিছু বিজ্ঞাপন প্রকাশ্যে এসেছে, যা দেখে বাঙালিদের কপালে ভাঁজ পড়তেই পারে। এক গয়না প্রস্তুতকারী সংস্থা তাঁদের দক্ষিণ কলকাতার একটি শাখায় নির্দিষ্ট একটি পদের জন্য চাইছিল ইংরাজি বা হিন্দি মিডিয়ামের প্রার্থীকে। বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করা প্রার্থী সেখানে ব্রাত্য। আবার, অনলাইন স্বাস্থ্য-বিষয়ক এক সংস্থাও চাইছিল হিন্দিভাষী প্রার্থী। হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গের বুকেই। দুটি ঘটনাতেই প্রতিবাদে মুখর হয় বাংলা পক্ষ। পরবর্তীকালে ওই দুই সংস্থাই তাদের বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে নেয়।

দিনকয়েক আগে, নামী এক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে প্রচার চালাচ্ছিলেন বাংলা পক্ষের সদস্যরা। ছাত্রছাত্রী ও স্থানীয় অভিভাবকদের বোঝাচ্ছিলেন ‘ডোমিসাইল-বি’ বাতিলের সম্পর্কে। অর্থাৎ বাংলায় মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তির ক্ষেত্রে বাঙালি ছাত্রছাত্রীদেরই প্রাধান্য দিতে হবে – এই সচেতনতা বাড়িয়ে তুলছিলেন তাঁরা। বাংলা পক্ষের এক সদস্যের কথায়, উক্ত প্রতিষ্ঠানের অবাঙালি কর্তা এরপরই কলকাতা পুলিশকে ফোন করেন এবং জানান, বাইরে প্রতিষ্ঠানের ‘রেপুটেশন’ নষ্ট করছে কয়েকজন। অথচ তাঁরা কেউই কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ভেতরে প্রবেশ করেননি। বাইরেই চালাচ্ছিলেন প্রচারকার্য। যাইহোক, এরপর কলকাতা পুলিশ আসে এবং তাঁদের সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য করে।

আরও পড়ুন
বাংলার বিলেত-জয়: লন্ডনে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা পেল বাংলা

মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ‘ডোমিসাইল-বি' জিনিসটি আসলে কী? সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা বা ‘নিট’ দিতে হয় মেডিক্যালে ভর্তি হতে হলে। ‘ডোমিসাইল-বি’ কোটার সুযোগে, অনেক ভিনরাজ্যের ছাত্রছাত্রীরা ভর্তি হয়ে যান পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে। বঞ্চিত হন বাংলার ছাত্রছাত্রীরা।

বাংলা পক্ষের এক সদস্য জানান - ‘প্রতিটা রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে সেই রাজ্যের ছেলেমেয়েদের জন্য ৮৫% সংরক্ষণের আইন আছে। এই সংরক্ষিত আসনগুলি সেই ছাত্রছাত্রীদের জন্যই, যারা ওই রাজ্যটিতে পড়াশোনা করেছে এবং তাদের বাবা-মা সেই রাজ্যেরই ভোটার। ডোমিসাইল ফর্মের মূলত দুটি ধরণ আছে – ডোমিসাইল-এ ও ডোমিসাইল-বি। বাকি রাজ্যগুলিতে ডোমিসাইল-এ ফর্মের মাধ্যমেই ৮৫% সংরক্ষিত আসনগুলিতে ভর্তি হওয়া যায়। এর জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সেই রাজ্যের কোনো স্কুল থেকেই পাশ করতে হয় ও আধার কার্ডের স্থায়ী ঠিকানা সেই রাজ্যেরই হতে হয়। কিন্তু বাংলায় তা হচ্ছে না। এখানে ডোমিসাইল-বি ফর্মের মাধ্যমেও ওই ৮৫% আসনে ভর্তি হওয়া যাচ্ছে। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক দেওয়া, বাবা-মার এখানকার ভোটার হওয়া – কিছুই প্রাধান্য পাচ্ছে না। বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের ধরে সহজেই লিখিয়ে নেওয়া যায় ডোমিসাইল-বি। আর এই সুযোগেই বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ সহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা প্রায় ১৫% ছেলেমেয়ে ভর্তি হচ্ছে রাজ্যের জন্য সংরক্ষিত ৮৫%-এর মধ্যে। অর্থাৎ বঞ্চিত হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের ছেলেমেয়েরা, যা অনৈতিক। মেডিক্যাল কলেজে রাজ্যের জন্য সংরক্ষিত আসনে ভর্তির জন্য ডোমিসাইল-বি বাতিল করতে হবে – এটা বাংলা পক্ষের দীর্ঘদিনের দাবি।’

আরও পড়ুন
১ নভেম্বর, বাংলাকে ঘিরে পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল পুরুলিয়ার

আবার, এই পশ্চিমবঙ্গেই অবাঙালি মালিক-চালিত বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে আমিষ খাবার নিষিদ্ধ। অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেও বাংলা বলায় 'নিষেধাজ্ঞা' রয়েছে বলে শোনা যায়। অথচ, সেইসব স্কুলগুলি ব্যবসা করছে বাংলার মাটিতেই। এসব নিয়েই জেগেছে ক্ষোভ। প্রশ্ন উঠছে, এই বাংলার বুকে কোথাও পড়তে গিয়ে কেন ভিন্ন সংস্কৃতি মেনে চলতে হবে? এই বৈষম্য দূর করতে এগিয়ে এসেছেন বাঙালিদেরই একাংশ। উগ্র পথ নেওয়া উচিত কি অনুচিত – তা ভিন্ন তর্ক। কিন্তু নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার এই আন্দোলন সময়েরই দাবি। হিন্দি-সহ অন্যান্য আগ্রাসী সংস্কৃতির হাত থেকে নিজেদের বাঁচানো। এক দেশের মধ্যেও, জাতিসত্তার মূল ভিত্তি এটাই।

একইসঙ্গে, প্রশ্ন থাকুক আপনাদের কাছেও – আমরা আগে বাঙালি, না আগে ভারতীয়?