৮, স্মিথ রোড, কলকাতা- ৭০০০১৩। এই ঠিকানাতেই অবস্থিত কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যশালী ও পুরনো বেকার হোস্টেল। ১৯১০ সাল থেকে নানা চড়াই উতরাইয়ের সাক্ষী থেকেছে এই বাড়িটি। হোস্টেলের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের গোপন কথা। এখানকারই তিনতলার ২৩ আর ২৪ নম্বর ঘরটি আলোচনার কেন্দ্রে থাকে। আজ আর ওই ঘরে কেউ থাকে না। একসময় থাকতেন একজন। ওপার বাংলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া এক দস্যি ছেলে। পড়তেন ইসলামিয়া কলেজে। তবে পড়ার থেকে বাইরের দিকেই মন ছিল বেশি। রাজনৈতিক কাজ, সভা, মিছিল— এই সবেই দিন কাটাতেন তিনি। স্বাধীনতার পর এই দস্যি ছেলেটি চলে যান পদ্মাপারে। পূর্ব পাকিস্তানের বুকে তিনিই ফুল হয়ে ফুটে উঠেছিলেন। তাঁরই ফেলে যাওয়া স্মৃতি আজও ধরে রেখেছে কলকাতার বেকার হোস্টেলের তেতলার ঘরদুটি। আর সেই দস্যি ছেলেটির নাম? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান!
আরও পড়ুন
সংগ্রামের ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন নিয়ে গর্জে উঠল ঢাকার ময়দান
বিংশ শতক জুড়ে যেসব বাঙালির নাম উঠে আসে, তার মধ্যে শেখ মুজিবুর যে একদম প্রথম সারিতে থাকবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু বাংলাদেশের নন, তিনি সমগ্র বাংলার নয়নের মণি। এই শহরের বুকেও ছড়িয়ে আছে তাঁর স্মৃতি। ছাত্রাবস্থায় এখানেই যে কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু! প্রত্যক্ষ করেছেন কলকাতার দাঙ্গা, কলেজে কলেজে পৌঁছে গেছেন বন্ধুদের নিয়ে। সেই বয়স থেকেই ক্রমশ রাজনীতির মূল স্রোতে ঢুকে পড়া তাঁর। তার সাক্ষী থেকেছে বাংলাদেশ, ঢাকা; সাক্ষী থেকেছে তিলোত্তমা…
আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প
মুজিবের প্রথম কলকাতা আগমন ১৯৩৯ সালে। সেটা ছিল নিছক বেড়ানোর জন্য। তার আগেই রাজনীতির সঙ্গে সামান্য পরিচিতি ঘটে গেছে তাঁর। আলাপ হয়েছে হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি’র সঙ্গে। ভ্রমণের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখাও করেন মুজিব। তখন তিনি ১৯ বছরের তরতাজা এক যুবক। নিজের গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনের কথাও ভাবতেন তিনি। সোহরাওয়ার্দিকেও সেই কথা জানান। গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগের কথা উঠলেই তখন সামনে আসত তরুণ শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। রাজনীতিই যে তাঁর ভিত্তিভূমি, ধীরে ধীরে সেটাই প্রকাশ হচ্ছিল।
আরও পড়ুন
সিঁড়িতে আজও শুকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ
এর পরেরবার আগমন অবশ্য পড়াশোনার জন্য। ম্যাট্রিক পাশ করে ১৯৪১-৪২ সালে চলে আসা কলকাতায়, আইন পড়তে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে (অধুনা মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি সেখানেও ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৫-৪৬ বর্ষে ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি। আজও কলেজের ছাত্র সম্পাদকদের তালিকায় উজ্জ্বল ‘এম রহমান’-এর নাম। দক্ষ সংগঠক হিসেবে তার আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন শেখ মুজিব। ইসলামিয়ার ছাত্র ইউনিয়নও তার বাইরে গেল না। কলেজে তিনিই তখন শেষ কথা। তাঁর মনোনীত করা প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতও না।
আরও পড়ুন
করোনা-সতর্কতা বাংলাদেশে, স্থগিত বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষের অনুষ্ঠান
সামনে থেকে দেখেছেন ৪৩-এর দুর্ভিক্ষ। তাঁর নিজের বর্ণনায়, “দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রাম থেকে লাখ লাখ লোক শহরের দিকে ছুটছে স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে। খাবার নাই, কাপড় নাই। ইংরেজ যুদ্ধের জন্য সমস্ত নৌকা বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। ধান, চাল সৈন্যদের খাওয়াবার জন্য গুদাম জব্দ করেছে।” এদিকে সাধারণ মানুষের কাছে খাবার নেই। এক দলা ফ্যানের জন্যও হাহাকার। রাস্তায় মরে পড়ে আছে শয়ে শয়ে মানুষ। কিছুই কি করা যায় না? এই দৃশ্য যে সহ্যেরও অতীত! কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দি সাহেবের কাছে ছুটে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আর্জি একটাই, এই মানুষগুলোকে কিছুটা সাহায্য যদি করা যায়। তারপরই তাঁর নির্দেশে তৈরি হল বিশাল এক সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট। গ্রামে গ্রামে খোলা হল লঙ্গরখানা। নিজের দেখা পরবর্তীতে বলছেন বঙ্গবন্ধু, “যুদ্ধ করে ইংরেজ, আর না খেয়ে মরে বাঙালি; যে বাঙালির কোনো কিছুরই অভাব ছিল না।”
আরও পড়ুন
হাতে বঙ্গবন্ধুর চিঠি, তবু মেলেনি সরকারি স্বীকৃতি, অপেক্ষায় মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী
১৯৪৬, ১৬ আগস্ট। কলকাতার বুকে শুরু হল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন। মুসলিম লীগ আর কংগ্রেসের টানাপোড়েন তখন তুঙ্গে। পাকিস্তান করতেই হবে— এমনটাই দাবি জিন্না’র। একই দাবি সঞ্চারিত হয়েছিল মুসলিম ছাত্রলীগের মধ্যেও। শেখ মুজিবও তার অংশ ছিলেন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনই ছিল তাঁর রাস্তা। কিন্তু হঠাৎই সেটা বাঁক নিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। প্রথমে কলকাতা, পরে নোয়াখালিতে ছড়িয়ে পড়ল দাঙ্গার আগুন। কি হিন্দু, কি মুসলিম - দলে দলে মারা যেতে লাগল মানুষ। শেষে দেশভাগ হল। মুসলিম লীগের দাবিও মানা হল। ভারত ভেঙে তৈরি হল পাকিস্তান - পূর্ব ও পশ্চিম। কিন্তু কোথাও যেন হতাশা বাংলার মুসলিম নেতাদের মধ্যে। হতাশ শেখ মুজিবও। তাঁর প্রাণের বাংলা যে দুভাগ হয়ে গেছে। আরও বড়ো কথা, কলকাতা পাকিস্তানের মধ্যে আসেনি। ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী শহরের সঙ্গে যে আত্মিক সম্পর্ক বাংলার সব মানুষের। এভাবে বিভাজন তো চাননি তাঁরা! শেষ চেষ্টা করা হল। দুই বাংলাকে একসঙ্গে করে একটা আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র। যা কিনা বাঙালির একান্ত নিজস্ব। শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি, শরৎ বসু-সহ অনেক নেতাই চেষ্টা করছিলেন এই পরিকল্পনা যাতে কার্যকর হয়। কিন্তু, সেটা ফলপ্রসূ হয়নি।
আরও পড়ুন
‘খড়ের চাল ফুঁড়ে, খাবারের প্লেটে এসে পড়ল পাকিস্তানি সেনার গুলি’
ঢাকা, বাংলাদেশই ছিল তাঁর আসল জায়গা। দেশভাগের পর ইসলামিয়া কলেজ থেকে চলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতাকে যে কিছুতেই ভুলতে পারেননি বঙ্গবন্ধু! মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কলকাতার বুকেই তৈরি হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র। এই শহর ভরসার জায়গা ছিল তাঁর। বেকার হোস্টেলের সেই দিনগুলো, কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেড়ানো, হাসি-দুঃখ-আনন্দ সবকিছু জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। এমনকি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এসেছিলেন এখানে। শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় যে গোটা বাংলার পরিচয়। কলকাতা কী করে দূরে সরে থাকবে সেখানে!
ঋণ- অসমাপ্ত আত্মজীবনী/ শেখ মুজিবুর রহমান
Powered by Froala Editor