সংগ্রামের ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন নিয়ে গর্জে উঠল ঢাকার ময়দান

১৯৭১ সাল। দিনটা ৭ই মার্চ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তৈরি হয়েছে মঞ্চ। তার সামনে পেছনে বা পাশে যেদিকেই চোখ যাচ্ছে, সেখানেই শুধু মাথা আর মাথা। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ জড়ো হয়েছেন সেখানে। উপলক্ষ শুধু একজন। সবার চোখে স্বাধীনতার স্বপ্ন। অবশেষে তিনি এলেন। মঞ্চে সেই দৃপ্ত, জ্বলন্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হল মুক্তিসংগ্রামের ঘোষণা। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়লে সেই আহ্বান— "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।" '৭১-এর ৭ই মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আর স্বাধীনতার আলোয় জ্বলে ওঠা বাংলাদেশের স্বপ্ন— একই তারে বাঁধা পড়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন
সিঁড়িতে আজও শুকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ

প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল আগে থেকেই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করছিলেন একদল তরুণ ছাত্র। সেখানেই গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনা ও পুলিশ। তারপর বহুবার আক্রমণ হয়েছে, আন্দোলন থামানোর চেষ্টা চলেছে। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান গর্জে ওঠে। ভরসার সূর্য হয়ে উঠে আসেন শেখ মুজিব ও তাঁর আওয়ামী লীগ। ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। এই জয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বাধিনায়ক নেতারা যে ভালো চোখে দেখেননি, তা বলাই বাহুল্য। ১৯৭১-এর ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। আচমকাই, শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হল সেটা। মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে 'রাজনৈতিক সংকট' বলে উল্লেখ করেছেন। ইঙ্গিতটি কোথায়, তা সহজেই অনুমেয়।

এমন কথা তো ছিল না। এ তো অপমান, স্বৈরাচারিতা! গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। শ্লোগান উঠল 'বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।' ঠিক হল, আগামী দুদিন বাংলার ঘরে ঘরে হরতাল পালিত হবে। সেখান থেকেই ঘোষিত হল ৭ই মার্চের বিশেষ সভার কথা। আশ্চর্যের ব্যাপার, তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তান - এই কথাটাই মুছে যেতে লাগল। নতুন দেশ, স্বাধীন দেশ, সবার দেশ, বাংলাদেশ! ২ মার্চই ঢাকা সাক্ষী থাকে স্মরণীয় একটি মিছিলের। সেখানেও গুলি চলে। মারা যায় ছাত্র-যুবারা। নিরস্ত্রদের ওপর এমন অত্যাচার আগুনে আরও বারুদ যোগ করেছিল।

আরও পড়ুন
দোকানজুড়ে কবিদের ছবি, নিজের মর্জিতেই বাঁচেন কবিতাপ্রেমী চা-বিক্রেতা

'সারা শহর উথাল পাথাল/ ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।' শহর নয়, গোটা দেশ জ্বলে উঠেছিল। পাকিস্তানের এই স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে। এবার দাবি স্বাধীনতার। যত বিক্ষোভের আঁচ বাড়তে থাকে, ততই বাড়ে অত্যাচারের মাত্রা। তাও থামার পাত্র নয় বাঙালি। থামবেন না মুজিবর রহমানও। পরিকল্পনা মাফিক ৭ মার্চ সবাই জড়ো হলেন রেসকোর্স ময়দানে। বাকিটুকু, ইতিহাস! বঙ্গবন্ধুর ওইদিনের ওই আহ্বান যেন রক্তে ঢুকে গিয়েছিল সবার। সমাবেশের ওপর নজর রাখছিল সরকারও। মজুত ছিল কামান, অত্যাধুনিক বন্দুক, অস্ত্র। কোনরকম 'বেচাল' দেখলেই, ফায়ার! ওইদিন রেসকোর্স মাঠে এইসব কিছু হয়নি। কিন্তু তারপর যে নারকীয় যজ্ঞ চলেছিল দেশ জুড়ে, সেই বীভৎসতা বর্ণনার অতীত।

আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প

১৯৭১ বাংলাদেশের জন্মের বছর, বহু মানুষের মৃত্যুর বছর, মুক্তিসংগ্রামের বছর। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নিজের দেশেই, নিজের বাড়িতে তাঁকে খুন হতে হল। দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া বংশের আর কোনো প্রদীপ বেঁচে থাকেনি। কিন্তু যে আগুন তিনি জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন ৭ মার্চে, তা মুক্তির সূর্য এনে দিয়েছে। একাত্তরের মার্চ তাই নবজাগরণের সময়, নিজের অস্তিত্বকে নতুন করে জানার সময়, লড়াইয়ের সময়।

More From Author See More

Latest News See More