‘গীতাঞ্জলি’-র অনুবাদ কুড়মালি-তে, নিজের বিলুপ্তপ্রায় মাতৃভাষাকে ‘উপহার’ অভিমন্যুর

“অভিমান তো আছেই, কিন্তু বাংলাকে আমি আমার দ্বিতীয় মাতৃভাষা হিসাবে মেনে নিয়েছি...”

অভিমন্যু মাহাত নব্বই পরবর্তী বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি। বাড়ি পুরুলিয়ার পাড়া-এ। মাতৃভাষা কুড়মালি। হ্যাঁ, কুড়মালি, অনেকেই এখনও নামই জানেন না যে ভাষার। একটা পরিকল্পিত ঘেরাটোপে আমাদের তথাকথিত ‘বিপন্ন’ বাংলার চাপে ঢাকা পড়ে যাওয়া একটি আঞ্চলিক ভাষা।

অভিমন্যু একজন ছৌ শিল্পী, ছোট থেকে লুকিয়ে মহড়ায় যান ছৌ-এর। সেখানে গান বেজে উঠলেই পা দোলে তাঁদের। রক্ত গরম হয়ে ওঠে, মাতৃভাষার গান, শিকড়ের ঐতিহ্য। কিন্তু তাও কি আছে? না নেই! সেই সংস্কৃতিতেও থাবা বসিয়েছে বাংলা। ছৌ-এর গান আস্তে ধীরে বদলে গেছে বাংলা আর মানভূমি ভাষার সংমিশ্রণে। কেবল কিছু বেশি মানুষ বুঝতে পারবে বলে এই আগ্রাসন মুখ বুজে সয়ে নিয়েছেন শিল্পীরা। অভিমন্যু স্পষ্ট বিরোধিতা জানান এই ঘটনার। এভাবেই একটি সংস্কৃতি আরেকটি সংস্কৃতিকে গিলে খায় বলে মনে করেন তিনি। অভিমান কি নেই? হ্যাঁ রয়েছে অল্পবিস্তর।

আরও পড়ুন
হেমন্ত কি হারিয়ে গেল বাংলা কবিতা থেকেও?

তখন শিশুবয়স। প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে দেখছেন কেমন যেন অন্যরকম দেখতে সব অক্ষরের ভিড় খাতা বইয়ে, তাদের রূপ আলাদা, তাদের উচ্চারণ আলাদা। বাড়িতে বাবা-মার বলা কথার সঙ্গে কোনো মিল নেই সেসবের। খিদে পেলে মাকে ডাকার সঙ্গে মিল নেই, বাবার কাছে বায়না করার সঙ্গে মিল নেই এই ভাষার। মাষ্টার বললেন, এটি বাংলা। সেই এক ভাষার কাঁধে উঠে বসল আরেকটি ভাষা। নিজের আবেগ, নিজের প্রকাশের গায়ে পাঁচিল তুলে তৈরি হল প্রতিবেশীর বাড়ি। অভিমন্যু বাংলা শিখলেন।

বাড়িতে, পাড়ায়, চলতে থাকল কুড়মালির চর্চা। কিছু কিছু কবিতাও লিখলেন। প্রকাশিত হল কাব্যগ্রন্থ ‘জহার। যে বইয়ের প্রচ্ছদে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘অভিমইননু মাহাতঅ’। মূলত ঝুমুর কবিদের হাতে টিকে ছিল এই ভাষার সাহিত্য। এগিয়ে এলেন এক তরুণ কবিও। কিন্তু কোনদিকে বাঁকে এই রাস্তা? কজনের কাছেই বা পৌঁছবে এই বই? অনুবাদের সুযোগও নেই বললেই চলে। বহু লড়াইয়ের পর ২০১৮-এ এসে রাজ্য সরকারি স্বীকৃতি। এতদিনে দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। পরের প্রজন্মের শিশুরা প্রায় ত্যাগ করেছে কুড়মালি। তারা বাংলায় স্বচ্ছন্দ হয়ে পড়ছে, বড়জোর মানভূমি-তে।

আরও পড়ুন
দোকানজুড়ে কবিদের ছবি, নিজের মর্জিতেই বাঁচেন কবিতাপ্রেমী চা-বিক্রেতা

বাংলা খানিক জোর করেই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল অভিমন্যুর ঘাড়ে। স্বভাবতই ভেবে নেওয়া যেত দৈনন্দিন কাজের বাইরে কোনওদিনই ভালোবাসা পাবে না এই ভাষা। অথচ চমক এখানেই। ভালো তো বাসলেন, এবং অভিমানের হাত না ছেড়েও বহু সৃষ্টি দিলেন এই বাংলায়।

প্রায় চারবছরের পরিশ্রমে বাংলা থেকে কুড়মালিতে অনুবাদ করলেন ‘গীতাঞ্জলি’, নাম ‘গিতেক নেহর’। আজ মাতৃভাষা দিবসে প্রকাশিত হল সেই প্রচ্ছদ। উপেক্ষিত মাতৃভাষাকে ভালোবেসে এই উপহার দিলেন অভিমন্যু।

‘মাঞ ভাখি কুড়মালি'

আমার মাতৃভাষা কুড়মালি। নিজের মাকে যদি মা না বলি, অন্যের মাকে মা বলব? 'পাতানো' মায়ের কাছে মাতৃদুগ্ধের স্বাদ পাব?’ প্রশ্ন তো থেকেই যায়, প্রশ্ন জাগে আমাদের মনেও। কিন্তু মুচকি হেসে উত্তরও দেন অভিমন্যু নিজেই। বাংলাকে দ্বিতীয় মাতৃভাষা হিসাবেই মেনে নিয়েছেন তিনি। ‘দ্বিতীয় মাতৃভাষা’, কানে বাজছে এই শব্দ। ছোটো ছোটো পরিসরে আপনার তথাকথিত অসহায় ভাষাও এভাবে গলা টিপে ধরছে না তো কারোর ঐতিহ্যের, কারোর সংস্কৃতির?