‘সুমন একক’-এ আলাপ, বন্ধুত্ব ও প্রেম – অলক্ষে বাঁশিটি বাজালেন কবীর

নব্বই-এর দশক। মঞ্চের ওপর স্পটলাইটের একটু ঝলক এসে পড়ছে দর্শকাসনে। মাঝে মাঝে অন্ধকারের ভেতর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে মুখটা। সদ্য কলেজপাশ তরুণীর আলগা কাজল আর পাটভাঙা তাঁতের শাড়ির আবছা অবয়বে একদৃষ্টে চেয়ে আছে দুটো চোখ। মঞ্চের ওপর থেকে ভেসে আসছে -

‘প্রথম প্রেম ঘুচে যাওয়ার যন্ত্রণাকে নিয়ে
কান্না চেপে ঘুরেছিলাম তোমারই পথ দিয়ে…’

এই পথ এসে মিশে গেছে সুমনে-সুমনে। ছেলেটির অপলক দৃষ্টির কাছে কী অবলীলায় কলকাতার সমস্ত রাস্তা এসে মিশে গেছে ঐ কলামন্দিরের অন্ধকার অডিটোরিয়ামে, সেখান থেকে শুরু হচ্ছে আরেকটা পথ, দুই পথিক জিরিয়ে নিচ্ছে কোনো মহীরুহের ছাওয়ায়…

আরও পড়ুন
ব্যক্তিগত প্রেমে মিশে গেল কলকাতাও, ঝড়ের বেগে ‘তোমাকে চাই’ লিখলেন কবীর সুমন

প্রায় পনেরো বছর পর যখন সেই তরুণের হাত ধরে তাঁর স্ত্রী হেঁটে আসছেন আরও একটি সুমন এককে, তখন সেই পথের দুপাশে ফুটেছে পলাশ।

"সুমনেই আলাপ, সুমনেই থাকি, এক সুমন একক থেকে আরেক সুমন এককের মাঝে আমরা বারো বছর সংসার করে ফেললাম…" - বলছিলেন বেহালার সেই মানুষটি, যাঁর জীবনের বাঁকে রয়েছে একটি সুমন একক।

সুমনের গান। চৌকো প্লাস্টিকের খোলসে রাখা রিল ক্যাসেট। এক প্রজন্মের দলিল। 'সেই যে গানগুলো আমাদের হাত ধরে হ্যাঁচকা টেনে বড় করে দিল' - বাবা বলতেন। সুমন মিলিয়েছেন। উপরের ঘটনার মতো এমন কত প্রেমের সাক্ষী সুমনের লাইভ শো তার হদিশ নেই আর। শুধু কি প্রেম?

সেই একটি ছেলে। কতই বা বয়েস, আঠারো কিংবা উনিশ, কোনো এক সুমন এককে গিয়ে একলা বসে আছে আপার টায়ারে, ঐ প্রথম। সুমন শোনা৷ এককোণে বসে শুনছে সে -

‘আমি বন্ধুর হাত ধরে চলে যাব হালকা চলার ছন্দে
আমি বন্ধুর বুক ভরে দেব সব আগামীদিনের গন্ধে…’

আরও পড়ুন
শেষ বয়সে গান লিখতে চেয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুরের দায়িত্ব কবীর সুমনের

পাশে বসা দর্শক তখন গাইছেন। প্রাণ ঢেলে গাইছেন গানটা। অডিটোরিয়াম উত্তাল। সেই এককোণে বসে থাকা ছেলেটিকে তুলে এনে গলা মেলানোয় সামিল করল পাশের জন, সেই পাশ থেকে শুরু হল নতুন আন্দোলন। সাড়া দেবার আন্দোলন, মঞ্চে গাইছেন সুমন, সামনে গাইছে একটুকরো কলকাতা শহর -

‘সুর চায় তোমাকে আমাকেও চাই তার
আমাদের মনে রং মিলে যাক দুনিয়ার, সাড়া দাও…’

সেই সাড়াতে মিলে গেল দুই বন্ধু। উনিশ বছর পর আরও এক সুমন এককে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আসছেন সেই দুজন। সেই পাশের এককোণে বসা ছেলেটি হাত ধরে নিয়ে আসছে সেদিনের সহশ্রোতাকে -
‘সুমন একক আমায় আমার কত প্রিয় বন্ধু যে দিয়েছে…’

বছর দশেক আগের কথা। এক প্রেমিক তার সদ্য কলেজপাশ তরুণী বান্ধবীকে নিয়ে এসেছেন সুমনের অনুষ্ঠানে। সে তখন হলুদ-কালো ট্যাক্সির কলকাতা শহর। দরজা খুলে নীল পাঞ্জাবি নেমে আসার পর হাত বাড়িয়ে দেওয়া ব্যস্ত বিকেলের শাড়ি পরিহিতা প্রেয়সীর দিকে। সে তখন এক যৌবনের কলকাতা, টানা রিকশা ফিকে হয়ে আসার কলকাতা। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী সেই বান্ধবীর জীবনে তখন কোথায়ই বা সুমন? তবু সুমনে মজে থাকা প্রেমিকের ডাক প্রত্যাখ্যান তো সহজ নয়। তবু মঞ্চের এক চিরতরুণ গিটারে একটা মেজর কর্ড ফেললেন। শুরু হল আলোর খেলা।

‘একলা হতে চাইছে আকাশ…’ - সে হাত চেপে ধরা পাশের মানুষটির। ঐ প্রথমবার শোনা – ‘গাছেরও মন কেমন করে…’

আরও পড়ুন
‘#ভাগ্যিসসুমনছিলেন’, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের অস্ত্র হয়ে উঠছে কবীর সুমনের গান

প্রায় বছর দশেক পর এক টেলিফোনে বলছিলেন সেই বান্ধবী। অনেক রাতে হয়তো সুমন এসেছিল…
‘সেই প্রথম আমার সুমন শোনা, সে প্রেম চলে গিয়েছে বহুদিন, সুমন আমাকে ছেড়ে যাননি, ওই যে আমার বাড়ির পাশের রাধাচূড়া গাছ, ও গাছের মনকেমনের কথা এই লোকটা কীভাবে জানল? আমার কাছে এ ছিল সেই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ… "

সুমন একক তিরিশ বছর ধরে বাঙালির মননকে জুড়ে গেছে শুধু, সে প্রেমে কিংবা বিচ্ছেদে, বিরহে বা বন্ধুত্বে। এই তিন শতকের শহরের বুকে দাঁড়িয়ে একেকটা গাছের কথা লিখেছেন সুমন মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে, আর তার ছায়া পেয়েছি আমরা। আর একে একে ঐ অন্ধকার মঞ্চে উঠে এসেছেন হিমাংশু দত্ত থেকে সলিল চৌধুরী, লালন ফকির থেকে অলোকনাথ দে হয়ে রবীন্দ্রনাথ। সুমন সনাতন বাংলা গানের পসরাকে নব্বই-এর শহরে দাঁড়িয়ে দিচ্ছেন আধুনিক, আধুনিক এবং আধুনিকতম ফর্ম্যাট, তার প্রকাশের জন্য তিনি গান লিখছেন, সুর করছেন, গাইছেন আর কলকাতাকে গাওয়াচ্ছেন। অর্কেস্ট্রার চলন থেকে অ্যারেঞ্জমেন্টে এসে পড়ছে কখনো জার্মানি কখনো আমেরিকার সঙ্গীতে, তাতে মিশে যাচ্ছেন রামপ্রসাদ, কীর্তনের মতো আদি সঙ্গীত। ওই ধুতি-পাঞ্জাবি থেকে পাজামা হাফশার্টের কলকাতায় দাঁড়িয়ে মঞ্চের ওপর ডেনিম শার্ট আর জিন্সে একজন বলছেন রোজা রুক্সেমবার্গের কথা, বলছেন হেইনরিখ ব্যোলের কথা, বলছেন নিকারাগুয়ার সংগ্রামের গল্প - বাঙালির মননের জানলা খুলে একটা সুমন নামক ঢেউ বিশ্বদর্শন করাচ্ছে - একটার পর একটা একক হাউসফুল!

নব্বই-এর শেষের দিক। এক কলেজের অনুষ্ঠানে মঞ্চে উঠলেন সুমন, চোখে একটা সানগ্লাস। সকলে অবাক, সুমনের চোখে সানগ্লাস কেন?

আরও পড়ুন
রাতের কলকাতায় ছুটে চলেছে জর্জ বিশ্বাসের ‘পক্ষীরাজ’ বাইক

কয়েক মিনিট পরেই নিস্তব্ধতা ভেঙে তিনি বলে উঠলেন – ‘বন্ধুরা আজ সানগ্লাস পরে এলাম, ভাবছি একদিন দূরবীন পরে মঞ্চে উঠতে পারব…’। হাততালিতে ফেটে পড়ল কলকাতার তারুণ্য!

সুমন একক তো শুধু শ্রোতার নয়, এ তো কবির, এ তো লেখকের - গানের বিপ্লব থেকে উঠে এসেছে সাহিত্য। জয় গোস্বামী যেমন মনে মনে কোথাও নিজেই হয়ে উঠতে চাইছেন সুমন -

"সুমন 'তোমাকে চাই' বলে লুঠ করে নিয়ে গেছে
তোমাকে, আমার কিছু করবার ছিল না তখন
আজ এই কাব্য নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তোমার
বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই সুমন।"

কবি ও কবিয়ালে সুমনের গানে মিশছে জয়ের কবিতা। কলকাতার নীল নকশায় মিশে যাচ্ছে সুর আর ছন্দ। পিনাকী ঠাকুর লিখছেন, লিখছেন শ্রীজাত। সে এক মুখে মুখে ঘোরা প্রবাদ উড়ল বসন্তের হাওয়ায় -
"দেখা হবে সুমনে-সুমনে…"

আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ! আকাশবাণী থেকে ৬ বছরের জন্য নির্বাসিত সুচিত্রা মিত্র

দেখা তো হবেই৷ যেভাবে হয়ে আসছে তিরিশ বছর ধরে। যে মঞ্চের সামনে দর্শক নয় সেজে থাকে এক টুকরো কলকাতা, যার প্রতিটা মুহূর্ত দেখেছে প্রেম, দেখেছে বন্ধুত্ব, দেখেছে বিচ্ছেদ। কিন্তু কোনোকিছুই সেই সুরের অকটেভ ছাড়িয়ে বেরোতে পারেনি, সেই সুমনামির ঢেউ থেকে বেরোতে পারেনি। মঞ্চ আর শ্রোতার মাঝখানে সুমনের ব্যারিটোন একটা সেতু এঁকে দিয়েছে। সেখানে এখনো রোদ ওঠে, বৃষ্টি হয়, এখনও রাজনৈতিক সুমন, সঙ্গীতকার সুমন, দার্শনিক সুমনের ওপর কোথাও এক জীবন্ত বিপ্লব দাঁড়িয়ে মঞ্চের ওপর গেয়ে ওঠেন -

‘শহরে জোনাকি জ্বলে না নয়তো
কুড়োতাম সে আগুনে নীল হয়তো,
যা কিছু নেই, নাই বা হল সব পাওয়া
না পাওয়ার রং নাও তুমি…"

আজ বাহাত্তরের জন্মদিনেও যে তাঁকে ছাড়া শহরে জোনাকি জ্বলে না…

Powered by Froala Editor