ব্যক্তিগত প্রেমে মিশে গেল কলকাতাও, ঝড়ের বেগে ‘তোমাকে চাই’ লিখলেন কবীর সুমন

একটা গান কি শুধুই কিছু কথা আর সুরের সমষ্টি? তার পেছনে থাকা গল্প, স্মৃতি, মানুষগুলোও যে প্রবলভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বিখ্যাত গানগুলির আড়ালেও কি এমনই কোনো কথা রয়ে গেছে? দেশ-জাতি-ভাষা নির্বিশেষে এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরে এসেছে মানুষের মনে। নিজেদের মতো করে উত্তরও খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কখনও গায়কের বা গীতিকারের সঙ্গে মিলেছে, কখনও মেলেনি। বাংলা সঙ্গীত জগতেও এমন নিদর্শন দেখা গেছে। আর সেই লোকটি যদি কবীর সুমন হন? নব্বইয়ের দশকে বাঙালির গানকে বদলে দেওয়া মানুষটার পেছনের কথাগুলোও তাহলে খানিক ফিরে দেখা যাক…

রাস্তায় যেতে আসতে, আমার-আপনার চোখে পড়ে উসকো-খুসকো কিছু মানুষ। শতচ্ছিন্ন পোশাক, একমুখ দাড়ি; আপন মনে কথা বলেছে। ঈশ্বরের সঙ্গে কি? এই প্রশ্নটাই তুলে দিয়েছিলেন কবীর সুমন। অবশ্য তিনি তখন ‘সুমন চট্টোপাধ্যায়’ নামেই পরিচিত। সালটা ১৯৯০। ভবানীপুরে সদ্য বাড়ি ভাড়া নিয়ে এসেছেন। এমন সময়ই দেখলেন মানুষটিকে; যদুবাবুর বাজারে যাওয়ার পথে। এই শুয়ে আছেন, এই বসে পড়ছেন। চারিদিকে কী হচ্ছে, কারা মারা পড়ছে, ক্ষমতায় কে এল— কোনো কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই মানুষটার। খাওয়ার কথাও কি মনে পড়ে না?

আরও পড়ুন
শেষ বয়সে গান লিখতে চেয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুরের দায়িত্ব কবীর সুমনের

হঠাৎ একদিন সুমন দেখেন, একটু যেন আলাদা হয়ে গেছে সে। দুটো হাত হাঁটুতে রাখা, চোখদুটো মলিন নয়; রীতিমতো উজ্জ্বল। বেশ নড়াচড়া করছে সে। কিসের যেন একটা উত্তেজনা। একটা অন্য মানুষ হয়ে উঠেছে যেন। সুমন ভাবতে শুরু করলেন। “আমার মনে হল— সে এক অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে সাপলুডো খেলছে। নিজের দানের পর প্রতিপক্ষের দানের জন্য তার সকৌতুক অপেক্ষা। খেলায় আত্মহারা শিশুর মতো সে তখন উত্তেজনায় টানটান।” এমনই ভাবনার সঙ্গে কয়েকদিন কাটালেন তিনি। গিটার বাজাচ্ছিলেন, সেই সময়ই উঠে এল কলম। যেন পরপরই আস্তে লাগল লাইনগুলো। তৈরি হল ‘পাগল’-

“এক মুখ দাড়ি গোঁফ
অনেককালের কালো ছোপছোপ
জটপড়া চুলে তার
উকুনের পরিপাটি সংসার
পিচুটি চোখের কোণে
দৃষ্টি বিস্মরণে মগ্ন
বাবু হয়ে ফুটপাতে
একা একা দিনরাতে রঙ্গে
পাগল
সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে।”

সুমন এমন একটা সময় গানের জগতে এসেছিলেন, যখন আমাদের চারপাশটা হঠাৎ করেই যেন অনেকটা বদলে যাচ্ছিল। কী যে হচ্ছে, কেন যে হচ্ছে, কিছুরই থই পাওয়া যাচ্ছিল না। ভালো বদল তো নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু বেশ কিছু জিনিস যেন ভেতরে ভেতরে সুদূরপ্রসারী একটা ক্ষতি করে দিয়ে যাচ্ছিল। সুমন দেখতে পেলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কিরকম নম্বরকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। যেখানে শিক্ষা নয়, মার্কশিটই শেষ কথা। ইংরেজি আর বাংলা মাধ্যমের বৈষম্যের সেই শুরু।

আরও পড়ুন
ফিকু থেকে রফি সাহাব— সুরের যাত্রায় বলিউডের তানসেনের গল্প

সুমন দেখছেন, ছোট ছোট বাচ্চারা, যাদের তখন ওড়ার বয়স; যারা একটু একটু করেই খেলাচ্ছলে আবিষ্কার করবে বিশ্বের রহস্যকে। তারা রাতদিন বড় ভারী ব্যাগ কাঁধে করে ছুটছে। ছুটেই চলেছে। কখনও স্কুল, কখনও টিউশন, কখনও সাঁতারের ক্লাস, তারপরেই আঁকার ক্লাস, সঙ্গে সঙ্গে ক্যারাটে, গান। সব মিলিয়ে হ-য-ব-র-ল! বাবা মায়েরা বলছেন, ‘কম্পিটিশনে’ টিকতে গেলে সবকিছু শিখতে হবে। সুমনের মতে, “রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তোতা কাহিনির সঙ্গে আরো অনেক কাহিনি লিখতেন। বাচ্চাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। অনেকেরই মুখ ব্যাজার, শুকনো, নিরানন্দ।”

এমনই এক সময় সুমন দেখলেন গলি দিয়ে একটি রিক্সা যাচ্ছে। ভেতরে ‘যিনি’ বসে, তার বয়স বছর চারেক হবে। স্কুল ইউনিফর্ম পরে সে একা একা স্কুলে যাচ্ছে; পাশে বিশাল ব্যাগ। আর পারলেন না। দৃশ্যটা যেন কুরে কুরে খেতে লাগল কবির সুমনকে। একটানে লিখে ফেললেন ‘সকালবেলার রোদ্দুর’-

“গাছগাছালি হাতগুলোকে
আকাশপানে মেলছে
একটা চড়াই অমনি দেখি
এক্কা দোক্কা খেলছে।
যে মেয়েটার খেলা দেখে
চড়াই পাখির শেখা
সেই মেয়েটাই যাবে স্কুলে
রিক্সা চেপে একা।”

গানটা একটানে লিখলেও, সুর আসেনি সঙ্গে। কষ্ট হয়েছিল। তখনও দৃশ্যটা লেগে আছে সব জায়গায়। আমরা কোথায় চলেছি, এই কথা সবসময় ভাবছিলেন সুমন। পরে অবশ্য সুর দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৩ সালে, 'বসে আঁকো' অ্যালবামের অন্তর্ভুক্ত হয় এই গান...

সুমনের গান যাঁরা শোনেন, তাদের অনেকের মনেই হয়ত একটা প্রশ্ন উঁকি মেরেছে। ‘তোমাকে চাই’-এর ‘তোমাকে’-টা কে? কাকে বলছেন সুমন? যার নামের সঙ্গে গানটি জড়িয়ে গেছে আষ্টেপৃষ্ঠে! কিন্তু ‘তোমাকে চাই’-এর প্রেক্ষাপট প্রেমের ছিল না একদমই। বরং সেখানে উঠে এসেছিল একাকিত্ব, বেঁচে থাকার চেষ্টা…

সালটা ১৯৮৬। ততদিনে আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছেন কবীর সুমন। চাকরি, ভবিষ্যৎ- এসব কিচ্ছু ভাবেননি তিনি। শুধু গান নিয়ে থাকবেন, শেখাবেন, এটাই ছিল উদ্দেশ্য। তৈরি হল দল ‘নাগরিক’। হঠাৎই ভেঙে গেল সেটা। বন্ধুদেরও ঠিক যেন চিনতে পারলেন না। যে আশা নিয়ে এসেছিলেন, সেসব ভেঙে পড়ছে। এদিকে অর্থের টানাটানি। মানসিক, শারীরিক সব দিক দিয়ে সুমন তখন পরাজিত একজন; নিঃসঙ্গ। তাঁর কথায়, “ভীষণ আত্মিক সংকটের মধ্যে কাটছিল কিছুদিন। কোথাও কোনো অবলম্বন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আশ্রয় খুঁজছিলাম। ছেলেমানুষের মতো ভালবাসা চাইছিলাম।” সামনেই দেখছেন আরও এক নিঃসঙ্গ মানুষকে, সমর সেন। যে কোনো মূল্যে বাঁচতে হবে তাঁকে।

আরও পড়ুন
প্যারিস থেকে কলকাতা, টেপরেকর্ডারে পথের সুর ধরেছিলেন দেবেন

এমন অবস্থায় হঠাৎই লিখে ফেললেন চারটি লাইন। ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই/ দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই…।’ কাকে বলছেন এগুলো? এ কি প্রেম? কার প্রতি, জীবনের? কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না। যেন তিনি নয়, লেখাটিই তাঁকে চালনা করছেন। একবারে লিখে ফেললেন ‘তোমাকে চাই’। পরে কথার ওপর সেতুর মতো বসেছে সুর। বাকিটা, ইতিহাস…

ঋণ-
সুমনের গান সুমনের ভাষা/ কবীর সুমন

More From Author See More