প্রতিদিন ম্যাচের পর বীভৎস বমি করত ছেলেটা। ঐ ছেলেটাই আবার পরের দিন মাঠে নামার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারত না...
যতবার ওই ছেলেটার দিকে তাকাই, ভীষণভাবে জড়িয়ে যাই তার সঙ্গে। ছেলেটা ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের মূল কারিগর। কিন্তু বিশ্বকাপ ও নিজের ম্যান অফ দ্যা সিরিজের পুরস্কার সুস্থভাবে উপভোগই করতে পারেনি। ঠিক ফাইনাল জয়ের পরপরই গন্তব্য হয়ে ওঠে হাসপাতাল। লক্ষ্য তখনও জয়, বিপক্ষ শুধু মৃত্যু। না তার অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ১৩৯ কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে সেই ১০৭ আমাকে আর তাতায় না। আমায় উত্তেজিত করে না ইংল্যান্ডের সঙ্গে ১১৮ করেও বল হাতে তার চার উইকেট। বিখ্যাত সেই ছয় ছক্কার ম্যাচ থেকে ২০১১ বিশ্বকাপ একা জেতানো, কোনোটাই আর তার প্রতি ভালোবাসার কারণ নয় আমার। এখন কারণ একটাই, আমার পড়া তার একটা ইন্টারভিউ...
সোনার সিংহাসনে বসতে যাওয়ার সময়ই যখন জীবন বিশ্বাসঘাতকতা করল, ক্যানসার ধরা পড়ল যখন, তখন বারবার একটাই প্রশ্ন ঘুরত তার মাথায় – ‘Why Me?’ প্রতিটা মুহূর্ত, হাসপাতালে কাটানো প্রতিটা একাকীত্বের রাত তাকে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলত, তুই শেষ। একটা লোক, যার প্রতিটা দিন শুরু হত দৌড় দিয়ে। যার চওড়া ব্যাটে ভর করে ভারত পেরিয়ে এল অসংখ্য মৃত্যুউপত্যকা, তার জীবন মৃত্যুর দোড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে। তিন-তিনটে বিশ্বজয়ের কাণ্ডারী, রাজত্ব ছাড়ার পথকে মানতে পারছিল না এত সহজে। আর ঠিক তখনই কীভাবে যেন ভিতর থেকে আওয়াজ উঠে এসেছিল তার মধ্যে, চারপাশের ‘Why Me’-র মধ্যে সেই আওয়াজ তাকে বলতে শিখিয়েছিল, ‘Try Me...’
হ্যাঁ, এই একটা কথা আমাকে ভাবিয়েছিল। সামান্য, সামান্য বিষয়ে জীবনকে দোষ দিয়ে নিজেদের অপদার্থতার অযুহাত খুঁজতে থাকা এই সমাজের বুকে দাঁড়িয়েও একটা লোক লড়াই করতে চাইছে। ফিনিশে লাইনে এসেও পুড়তে পুড়তে চাইছে নিজেকে আরও শুদ্ধ করতে৷ তাই তো আগে বার বার মেজাজ হারিয়ে ফেলা তিনি, এখন অনেক বেশি শান্ত। আগের উদ্ধত তিনি, এখন অনেক বেশি শীতল। আগের খ্যাপাটে তিনি, এখন অনেক বেশি পরিণত। কিন্তু কম বয়সে অন্তরের যে আগুন দাবানল হয়ে আছড়ে পড়ত মাঠে, তাতে শীতলতার কোনো ছোঁয়া লাগেনি এখনও। এবং এমন এক আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে যে শান্ত কিন্তু সুপ্ত নয়। যে সামান্য নড়ে উঠলেই তাণ্ডব শুরু হয়ে যেতে পারে বাইশ গজে। তাই তো ফিরে এসে তার অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে অসামান্য ১৫০ রানের ইনিংসটায় পাগলের মতো কেঁদে ফেলি। গ্যালারিতে আছড়ে পড়া প্রতিটা ছয়ের সঙ্গে বেঁচে উঠি নতুন করে..
কিছু মানুষের জীবন শুধু তার নিজের থাকে না। সবার হয়ে যায়। কিছু খেলোয়াড়, তার খেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে চলে যান অনেক ঊর্ধ্বে। তাদের জীবনের ওঠানামা তখন শুধু তার থাকে না, সমগ্র জগতের কাছে জীবনশিক্ষার গল্প হয়ে যায়। তখন সেই মানুষকে নিয়ে লিখতে বসা, ব্যক্তিপুজো থাকে না আর, হয়ে যায় জীবনের আরাধনা। আর এভাবেই ঈশ্বরের দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহারকে ভালোবেসে যত্ন করতে শিখিয়ে যান ‘দেবদূত’ যুবরাজরা...