“মানুষের পাশে দাঁড়াতে গেলে সবসময় প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, এমনটা নয়। আমাদের যতটুকু সামর্থ্য, তার মধ্যেই ইচ্ছা থাকলে কাজ করা যায়। এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম। আর ধীরে ধীরে সাফল্যও তো পাচ্ছি।” বলছিলেন সৌম্যদীপ্ত বসু। তাঁর উদ্যোগেই গতকাল বড়বেড়িয়া গ্রামে উদ্বোধন হল একটি স্থানীয় পাঠাগার, ‘বোধপীঠ’। তবে এখানেই শেষ নয়, আশেপাশের আরও তিনটি গ্রাম মিলিয়ে বেশ কয়েকটা গ্রন্থাগার তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছেন তিনি।
কোনো একটি বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি নয়, গোটা বেড়িয়া অঞ্চলই হয়ে উঠতে চলেছে একটি লাইব্রেরি। গতকাল পথচলা শুরু হল এই অভিনব উদ্যোগের। ২২ বছরের সৌম্যদীপ্তের হাত ধরে বইয়ের সাজে সেজে উঠছে ডায়মন্ডহারবারের কাছে বড়বেড়িয়া গ্রাম। গ্রামের ছেলে সৌম্যদীপ্ত বসু সামনে থেকে দেখেছেন অঞ্চলের পরিস্থিতি, সেখানকার মানুষের অভাব অভিযোগ। তাঁর কথায়, “আমাদের এখানে কিছুদিন আগে পর্যন্ত একটা সরকারি গ্রন্থাগার ছিল। তবে গোটা অঞ্চলে মাত্র একটিই লাইব্রেরি, সেখানেও নানা নিয়মকানুনের জন্য অনেকেই বই নিতে আগ্রহী হতেন না।” তাই সৌম্যদীপ্ত চেয়েছেন সবাই যেন বাড়ির কাছেই প্রয়োজনীয় বই পেয়ে যান হাতে নাগালে।
গ্রামের বাস্তবতায় সৌম্যদীপ্ত সবথেকে বেশি করে দেখেছেন শিক্ষার সীমাবদ্ধতা। সেই বাঁধ ভেঙে ফেলতেই ‘বোধিপীঠ’ নামে এই উদ্যোগের পরিকল্পনা মাথায় আসে তাঁর। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যোসাল ওয়ার্ক বিভাগের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া সৌম্যদীপ্ত-র ডাকে সাড়া দিয়েছেন বড়বেড়িয়া গ্রামের অনেকেই। তাঁর কথায়, “বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শিখেছি, তাকে হাতে কলমে পরীক্ষা করার এটা একটা সুযোগ।”
আরও পড়ুন
পড়াশোনার সুযোগ পাননি নিজে, পাটুলিতে স্ট্রিট লাইব্রেরি গড়ে ‘স্বপ্নপূরণ’ দোকানির
লকডাউনের সময় সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ছাত্রাবাস থেকে গ্রামে ফিরে আসেন সৌম্যদীপ্ত। তার কিছুদিনের মধ্যেই এসে পড়ে আমফানের আঘাত। সমস্ত অঞ্চল জুড়ে শুধুই হাহাকার। তবে সৌম্যদীপ্তকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত করে স্কুল পড়ুয়াদের পড়াশোনার সমস্যা। প্রায় সবার পড়ার বই জলে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এই সময় প্রথম একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি তৈরি করেন তিনি। পড়ুয়ারা প্রয়োজনীয় বই নিয়ে যায়। পড়া শেষ হলে আবার ফেরত দিয়ে যায়। তখন অন্য কেউ সেই বই নিয়ে যেতে পারে। তবে বই পড়া তো শুধু স্কুল পড়ুয়াদের জন্যই নয়, সমস্ত মানুষের জীবনেই ভীষণভাবে প্রয়োজন। সেই চাহিদা মাথায় রেখে, গোটা গ্রামকেই লাইব্রেরি করে তুলতে চান তিনি।
আরও পড়ুন
অষ্টাদশীর স্বপ্নপূরণ, বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে লাইব্রেরি তৈরি রাহিলার
আরও পড়ুন
চায়ের দোকানেই ওপেন লাইব্রেরি, তরুণদের হাত ধরে ‘বই-বিপ্লব’ বর্ধমানে
সৌম্যদীপ্ত চেয়েছিলেন, প্রতিটা পাড়ায় থাকবে একটি করে লাইব্রেরি। গ্রামের সমস্ত মানুষ যেন সহজে সেই লাইব্রেরির পরিষেবা পান, এটাই উদ্দেশ্য। সমস্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথাও বলেন তিনি। এই উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা বোঝান তাঁদের। তবে বই সংগ্রহের কাজটা সৌম্যদীপ্ত করলেও, রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে বইয়ের হিসাব রাখার দায়িত্ব লাইব্রেরি-বাড়ির সদস্যদেরই। অনেকে এই দায়িত্ব নিতে দ্বিধা করলেও মোটামুটি প্রতিটা পাড়া থেকেই অন্তত একজন এগিয়ে এসেছেন। এরপর সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে বেশ কিছু মানুষের কাছে বইদানের আবেদনও পৌঁছে দেন সৌম্যদীপ্ত। এর মধ্যেই বেশ কিছু বই জোগাড় হয়েছে। তবে সারা গ্রামকে লাইব্রেরি বানিয়ে তুলতে আরও অনেক বই লাগবে। তাই সবাইকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
লকডাউনের সময় পেরিয়ে এখন কর্মহীন বাবা শুভেন্দু বসু। কোনোক্রমে সংসার চালাচ্ছেন মা দ্রৌপদী বসু। তবে তাঁরাই ছেলের উদ্যোগে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন। গ্রামে গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্নে সাফল্য পাক সৌম্যদীপ্ত। আর এইসব ছোটো ছোটো উদ্যোগই তো পারে সারা দেশের চেহারাটা বদলে দিতে।
Powered by Froala Editor