দরিদ্র পরিবারগুলির হাতে ত্রাণসামগ্রী, উদ্যোগে গুসকরার একঝাঁক তরুণ-তরুণী

দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে গেল, সারা দেশের মানুষ ঘরের মধ্যে বন্দি। করোনা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া আটকাতে লকডাউন ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। কিন্তু এই লকডাউনের জেরে স্বাভাবিক জনজীবন ইতিমধ্যে বিপর্যস্ত। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন দিন আনি দিন খাই মানুষরা। ভাইরাসের আক্রমণের সঙ্গেই গ্রাস করেছে দারিদ্র্য, অনাহার। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে অবস্থাটা আরও ভয়ানক। কীভাবে দিন কাটছে তাঁদের, সে কথা ভাবলেই অবাক হতে হয়।

তবে অন্ধকারের উল্টো দিকেই তো আলো থাকে। তেমন আলোর সন্ধান দিতে পারা মানুষের সংখ্যাটাও খুব কম নয়। করোনার দিনগুলিতে এক ব্যতিক্রমী মানবিক উদ্যোগের সাক্ষী থাকল পূর্ব বর্ধমান জেলার গুসকরা গ্রাম। এখানকার অনাহারক্লিষ্ট মানুষদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন তরুণ তরুণীদের একটি ছোট্ট দল। দলের নাম 'লেটস ট্রাই ওয়ান্স'। "একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক না, এই মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ঠিক কতটা সামর্থ্য প্রয়োজন।" প্রহরকে এই কথাই জানালেন উদ্যোক্তা হুসনে সবনম।

কয়েক বছর আগে পড়াশুনো শেষ করে সদ্য অভিনয় জগতে পা রেখেছেন হুসনে সবনম। কর্মসূত্রে তাঁকে কলকাতাতেই থাকতে হয়। তবে লক-ডাউনের সময় বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফেরার আনন্দ তো ছিলই, সঙ্গে ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। প্রতিবেশীদের দারিদ্র্যের চেহারা নীরবে দেখে যেতে পারছিলেন না তিনি। রাত জেগে ছোট বোনের সঙ্গে পরামর্শ করতেন, কীভাবে এঁদের পাশে এসে দাঁড়ানো যায়! কথায় কথায় বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করলেন। অধিকাংশই স্কুল কলেজের পড়ুয়া, অথবা সদ্য কোনো পেশায় যুক্ত হয়েছেন। অতএব সামর্থ্য খুব সামান্যই। তবু সেটুকু নিয়েই শুরু হল কাজ।

গত ২ এপ্রিল আশেপাশের কয়েকটা গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলির হাতে চাল, ডাল, আলু, পিঁয়াজ, তেল ও অন্যান্য কিছু খাবারের সামগ্রীর একটি করে প্যাকেট তুলে দিলেন তরুণ-তরুণীদের ছোটো এই দলটি। আর হ্যাঁ, খাবারের সঙ্গে একটি করে সাবান। প্রত্যেক সদস্যের মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। সেইসঙ্গে গ্রামবাসীদের আবেদন করছেন, পরিচ্ছন্ন থাকুন এবং প্রত্যেকের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। করোনা ভাইরাসকে আটকাতে যতটুকু করা সম্ভব।

"প্রথমে ভেবেছিলাম পরিচয় গোপন রেখেই কাজ করব। কিন্তু তারপর আর সেটা সম্ভব হল না। অনেকেই জানতে পেরে গেলেন।" এই জানতে পেরে যাওয়াটা যেন একটা কুণ্ঠার বিষয়। কিন্তু তাতে অবশ্য একদিকে ভালোই হয়েছে বলে মনে করছেন হুসনে সবনম। অনেকে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আবার অনেকে নিজের নিজের এলাকাতেও এমন উদ্যোগ নিতে শুরু করছেন। "আমাদের তো তেমন সম্বল কিছু নেই। প্রত্যেকের সাহায্য নিয়েই কাজটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।" বলছিলেন তিনি। প্রথমদিন ১০২টি পরিবারের হাতে খাবারের সামগ্রী তুলে দিতে পেরেছিলেন তাঁরা। পরের দিন, ৩ এপ্রিল সেই সংখ্যাটা দাঁড়ালো ১২৭। লক-ডাউনের শেষে জনজীবন আবার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অন্তত এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান হুসনে সবনম। তবে তার জন্য অবশ্যই প্রত্যেকের সহযোগিতা প্রয়োজন।

ইতিহাসে বোধহয় প্রত্যেক মহামারীর দোসর হয়ে এসেছে অনাহার। রোগের শিকার হয়ে মানুষ মারা গিয়েছেন, আবার অনেকেই মারা গিয়েছেন না খেতে পেয়ে। আর করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ তো বিশ্বব্যাপী মহামারীর চেহারাই নিয়েছে। এই সময়টাও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এর মধ্যেই এমন মানবিক উদ্যোগগুলিই আশার আলো দেখায়। সুদিন কাছে আসবেই। এই লক-ডাউনের শেষে যে একটা নিরাপদ সময় অপেক্ষা করছে।