জাপানের বিখ্যাত কবি ওকাকুরা চাইলেন ভারতবর্ষকে বুঝতে। তাই প্রথমেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের কাছে। তিনি তো তখন শিকাগো ধর্মমহাসভায় সেই বিখ্যাত বক্তৃতা দিয়ে ভারতের একমাত্র আন্তর্জাতিক মুখ। কিন্তু বিবেকানন্দ তাঁকে হতাশ করলেন। বললেন, "এখানে আমার সঙ্গে আপনার কিছুই করণীয় নেই। এখানে তো সর্বস্ব ত্যাগ। রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে যান। তিনি এখনও জীবনের মধ্যে আছেন।" এরপর ওকাকুরা এলেন রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে। কিন্তু তিনি জাপানি কবিকে বললেন, "ভারতকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন।" পরে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই এদেশের সঙ্গে এক দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক তৈরি হয় ওকাকুরার। কিন্তু এদেশের দুই মহামানবের পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শনের এমন ছবি সত্যিই অবাক করে।
দুই মহামানবের জন্মের পার্থক্য মাত্র ২ বছর। বাড়ির দূরত্বও খুব বেশি নয়। তবে দুজনের মুখোমুখি সাক্ষাতের কোনো স্বীকৃত তথ্য কথাও পাওয়া যায় না। দুজনের সম্পর্ক আসলে কেমন ছিল, তা খুঁজে পাওয়া যায় দুজনের জীবনের বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনায়। অবশ্য জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বিবেকানন্দের যাতায়াত ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। দেবেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের বাল্যবন্ধু ছিলেন নরেন্দ্রনাথ। তখনও তো তিনি বিবেকানন্দ হননি। সেই সূত্রেই ঠাকুরবাড়িতে তাঁর দরজা খুলে যায়। আর এখানেই পরিচিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গেও।
রবীন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত যে বিবেকানন্দকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা 'সংগীত কল্পতরু' বইতে। এখানে রামকৃষ্ণ মিশনের জন্য অনেকগুলি গানের সঙ্গে তিনি সংকলিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখা ১১টি গানও। আর এইসব গান তিনি নানা সময় গুরু শ্রীরামকৃষ্ণকেও শুনিয়েছিলেন। ১৮৮৫ সালের ১৪ জুলাই বাগবাজারের বলরাম বসুর বাড়িতে তিনি শুনিয়েছিলেন 'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা', 'গগনের ভালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে', 'মহা সিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিত' প্রভৃতি গান। এছাড়াও শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি শুনিয়েছিলেন, 'দিবানিশি করিয়া যতন', 'দুঃখ দূর করিলে দরশন দিয়ে', 'এ কি সুন্দর শোভা'। বিবেকানন্দের জীবনের একমাত্র পথপ্রদর্শক সেই রামকৃষ্ণের মৃত্যুর ৯ মাস পর বরানগর মঠে বসে তিনি গেয়েছিলেন 'আমরা যে অতি শিশু, অতি ক্ষুদ্রমন'। এমনকি কৃষ্ণকুমার মিত্রের বিবাহ অনুষ্ঠানেও তিনি রবীন্দ্রনাথের লেখা কতগুলি গান পরিবেশন করেছিলেন বলে জানা যায়। এগুলি হল, 'এ কি সুন্দর শোভা', 'সখী আমারই দুয়ারে কেন আসিল নিশিভোরে'।
দুই মহামানবের যোগাযোগের একমাত্র সেতু হয়ে থেকে গিয়েছে এই গান। ছোটবেলা থেকেই এই একটি জিনিসের সঙ্গে যোগাযোগ নরেন্দ্রনাথের। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ঠাকুরবাড়ির নানা অনুষ্ঠানেও ডাক পড়ত তাঁর। আদি ব্রাহ্মসমাজের পঞ্চাশ এবং একান্নতম সাংবাৎসরিক অনুষ্ঠানেও নরেন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দ্বিপেন্দ্রনাথ। সেই অনুষ্ঠানেও রবীন্দ্রনাথের লেখা ব্রহ্মসঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি গেয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ, গগণেন্দ্রনাথ প্রমুখের লেখা গান। এরপর হিন্দু মেলাতেও নরেন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের লেখা গান। গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ভাষায় বিবেকানন্দের মতো 'এমন উদার বিশ্বতোমুখ গায়ক সচরাচর দেখা যায় না'। তিনি দেবেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ এবং স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা গানও তিনি গেয়েছেন বিভিন্ন সময়। এবং সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের 'দুই হৃদয়ের নদী' গানটি তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছেই শিখেছিলেন।
আরও পড়ুন
পিতৃহারা বিবেকানন্দের বাড়িতে গোপনে অর্থসাহায্য, চাকরিতেও সহযোগিতা শ্রীম-র
তবু দুই নদীর স্রোত শেষ পর্যন্ত মেলেনি কোথাও। একদিকে রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মানবধর্মের উপাসনা করে গেলেও ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে তার যোগাযোগ থেকেই যায়। অন্যদিকে বিবেকানন্দের শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলন বক্তৃতার পর দেশজুড়ে যে হিন্দুত্ববাদের ঝড় ওঠে, তার ধাক্কায় প্রায় হারিয়ে যায় ব্রাহ্ম সমাজ। কিন্তু সেই বিবেকানন্দের মৃত্যুতে স্মরণসভার সভাপতিত্ব করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দুই মহামানব একে অপরকে ঠিক কতটা প্রভাবিত করেছিলেন, তার সাক্ষ্য পাওয়া যাবে না কোনোদিনই। শুধু গানগুলো থেকে যাবে।
তথ্যসূত্রঃ
১. বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
২. প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ, বিধান মুখোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
আরও পড়ুন
‘নতুন মাস্টার পড়াতে পারেন না’, শুনে বিবেকানন্দ-কে চাকরি থেকে বরখাস্ত বিদ্যাসাগরের
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
কুড়ি রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন বিবেকানন্দ, বাংলার ‘ডব্লিউ জি গ্রেস’ বলা হত উপেন্দ্রকিশোরের দাদাকে