‘ইতিহাস খুন হয় ধর্মের চাপে’। কোন প্রসঙ্গে লেখা মনে নেই, তবে বহুকাল আগের এই কথাটাই যেন বারবার সত্যি হয়ে উঠছে আজকাল। প্রতিনিয়ত এমনই এক মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়ছি আমরা, যেখানে নিজেদের বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য নেই কোনো। ঢুকে পড়ছি, না বাধ্য হচ্ছি? চারপাশ বদলে গেলে, ‘শান্ত’ বাঙালি আর কতটুকু প্রতিরোধ করবে! নাকি বাঙালির একাংশ আজ নিজেকে বিলিয়ে দেওয়াতেই পরমার্থ খুঁজে পায়? সম্প্রতি একটা ঘটনায় এই প্রশ্নগুলো তীব্র হয়ে ধরা দিল মনে।
হাওড়ার রামরাজাতলা। নামের মধ্যেই লুকিয়ে ইতিহাসের শিরশিরে ইঙ্গিত। প্রায় আড়াইশো বছর আগে স্থানীয় জমিদার অযোধ্যারাম চৌধুরী এখানে রামপূজা চালু করেন। শোনা যায়, স্বপ্নাদেশ পেয়েই শুরু এ-উদ্যোগ। নইলে হঠাৎ করে সে-আমলের বাঙালি জমিদার রামের পূজা শুরু করবেনই বা কেন! শিবমন্দির কিংবা কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার চলই ছিল বেশি। রামমন্দিরের কথা শুনে তাই অবাক লাগতেই পারে। এ-কারণেও একটি ব্যাতিক্রম বইকি!
ইতিহাস বলে, রামমন্দির তৈরির আগে ওই অঞ্চলে মূল আরাধনা ছিল সরস্বতীর। বিস্তর মতানৈক্য পেরিয়ে, সরস্বতীর উপাসক ও রামোপাসকদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়। সেই থেকে রামপূজা অন্যতম উৎসব হয়ে ধরা দেয় সেখানে। উৎসবই বটে। এমনই প্রভাব, যে অঞ্চলটির নামই হয়ে গেল রামের নামে। ‘রামরাজাতলা’। এখনও প্রতিবছর রামনবমীর দিন থেকে শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার পর্যন্ত মেলা চলে। পশ্চিমবাংলার দীর্ঘতম মেলা এই রামরাজাতলাকে ঘিরেই। তারপর, বিসর্জন দেওয়া হয় সেই মূর্তির। প্রতিবছর এই চারমাস ভক্তরা দেখতে পান রাম-কে।
আচ্ছা, ‘রামরাজা’ নামে পূজিত হন কেন? ভাবতে গেলে কৌতূহল তো জাগবেই! জমিদার অযোধ্যারামের নাম কি অঞ্চলের নামকরণে ভূমিকা রেখেছে? ‘রামরাজা’-র উৎপত্তি কি সেই থেকেই? কেননা, এক অদ্ভুত বাঙালিয়ানায় মোড়া এই শব্দবন্ধটি। ‘শ্রীরাম’ কিংবা ‘রামচন্দ্র’ শুনে অভ্যস্ত কানে ‘রামরাজা’ সম্বোধন বিস্ময় তো জাগায়ই! অঞ্চলের অধিবাসীরাই যে ভালোবেসে ‘রামরাজা’ নাম দিয়েছেন, তাতে আর সন্দেহ থাকে না কোনো। এ যেন রামের বাঙালি হয়ে ওঠা। সে-কারণেই দেখা যেত, গোঁফ আছে তাঁর। আমরা ক্লিন-শেভড ছবি বা মূর্তি দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু বাঙালি যেমন শিবের পেটে নোয়াপাতি ভুঁড়ি বসিয়েছে, ঠিক তেমনি রামকেও দিয়েছে গোঁফ। ঘরের লোক না হলে কি হয় এমন!
দেখা যেত, যায় না আর। কারণ রামরাজার মন্দিরে যে মূর্তিটি ছিল রাম-সীতার, সেটি তো প্রতিবছর বিসর্জিত হয়, আবার বানানোও হয়। তিনশো বছর ধরে চলে আসছে এমনই। কিন্তু সম্প্রতি সেই প্রাচীন মন্দিরের উল্টোদিকের ভূমিতে পুকুর বুজিয়ে নির্মিত হয়েছে আরও একটি মন্দির। সেখানে পাথরের রাম-সীতা বিরাজমান থাকবেন সারাবছর। কেন এই নতুন মন্দির তৈরি করতে হল? যুক্তি – যাতে সারাবছরই রাম-সীতার দর্শন পাওয়া যায়, সে-কারণেই এমন উদ্যোগ। দর্শনার্থীরা উৎসবের চারমাস সনাতন মূর্তি দেখবেন, আর বাকি সময়টুকু উল্টোদিকের মন্দিরের নবকলেবরটিকে। অদ্ভুত যুক্তি, সন্দেহ নেই!
আশ্চর্য লাগে, এতদিনের ঐতিহ্যের ছিটেফোঁটাও নেই নতুন মন্দিরে। বদলে গেছে রাম-সীতার গাত্রবর্ণ। মুখাবয়বে বাঙালিয়ানার ছিটেফোঁটা নেই একটুও। বরং অবাঙালি মহল্লায় পূজিত রামের সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় নতুন মন্দিরের চেহারার। শুধু তাই নয়, প্রাচীন মন্দিরে রাম-সীতার সঙ্গে লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন, বিভীষণ, ব্রহ্মা, শিব, সরস্বতী প্রমুখের যে মূর্তি ছিল, উধাও তাঁরাও। কিংবা ছড়িয়ে গিয়েছেন একাধিক কুঠুরিতে। হ্যাঁ, তাঁদের মুখাবয়বেও অবাঙালি ছাপ স্পষ্ট।
আরও পড়ুন
রামকৃষ্ণকে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনালেন তরুণ নরেন্দ্রনাথ, গুরুর মৃত্যুশোকেও সঙ্গী সেই গানই
হয়তো সামান্য বিষয়। চারপাশের বড়ো-বড়ো দুর্যোগের প্রেক্ষিতে, বিশেষত এই করোনাকালে এটি নিয়ে আলোচনার মানেই হয় না। তবু চিন্তা হয়। একটি অঞ্চলের নিজস্বতা, বৈশিষ্ট্য হারিয়ে গেল এভাবে। ‘হিন্দুস্তানি’ সংস্কৃতি সেঁধিয়ে গেল বাংলার জনপদেও যে মন্দির ঘিরে এই জনবসতির এত রমরমা, সেই প্রাণকেন্দ্রই কি হারিয়ে গেল কোথাও? আজ এ-বিষয় এড়িয়ে যেতেই পারি, কিন্তু অনাগত ভবিষ্যতে আপনার-আমার পরিচিত দৃশ্যগুলোও যদি এভাবে ক্ষইতে থাকে, হারিয়ে যায় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য – সেদিন স্মৃতি হাতড়ে আফশোস করব না তো?
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
যুগে-যুগে রামায়ণ লিখেছেন যে সাহসিনীরা, তাঁদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন নবনীতা