“দুপুরের ঝড়টা সবে হয়েছে। নেটওয়ার্ক একেবারেই ছিল না। তারপর টাওয়ার আসতেই খবর পাই পাথরপ্রতিমার কামদেবনগরে জলস্তরে উচ্চতা এতটাই উঠে এসেছে যে পানের বরজ, কাঁচা বাড়ি— সবই জলের তলায়। প্রায় তিনশোটি পরিবার সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। সমস্ত প্রস্তুতিই ভেস্তে গেছে বিপর্যয়ে। নষ্ট হয়ে গেছে সবকিছু। কোনোক্রমে প্রাণ বাঁচাতে গ্রামবাসীরা উঠে এসেছেন স্কুলবাড়িতে। ঘণ্টা দেড়েক আগে ওখানে গিয়ে আজকে রাতটা চলার মতো শুকনো খাবারের বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসা গেছে।”
বলছিলেন ‘পাথরপ্রতিমা রানার্স’ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য নীলাঞ্জন মিশ্র। এক বছরের পুরনো ক্ষতই যেন দগদগে হয়ে উঠেছে আবার। বুধবার সকালেই ওড়িশার বালাসোরের কাছে আছড়ে পড়ে শক্তিশালী ইয়াস। তার প্রকোপ থেকে রেহাই পেল না বাংলাও। প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। গতির নিরিখে কোনোভাবেই আমফান কিংবা ফণীর সমতুল্য ছিল না এই ঘূর্ণিঝড়। কিন্তু তার ক্ষয়ক্ষতি ছাপিয়ে গেল সমস্ত রেকর্ডকেই। বিগত ৩৬ বছরে এত বড়ো বিপর্যয়ের কি সাক্ষী থেকেছে সুন্দরবন? জানা নেই।
নীলাঞ্জনবাবু জানালেন, “আয়লার সময় ৭-৮টি বাঁধ ভেঙেছিল। আমফানের সময় ১০-১২টা। কিন্তু এবারে বাঁধ ভাঙার থেকেও জলস্তর বেড়ে যাওয়া ভেসে গেল বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অধিকাংশ জায়গাতেই বাঁধ টপকে লবণাক্ত জল ঢুকে গেছে গোটা অঞ্চলে। এমনকি ফ্লাড সেল্টারগুলোর অবস্থাও বেশ আশঙ্কাজনক। রাতে সেগুলোর মধ্যেও জোয়ারের জল ঢুকে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।”
তবে প্রস্তুতি কি একেবারেই নেওয়া হয়নি? না, তেমনটা নয়। অনেক জায়গাতেই দ্বিস্তর বাঁধের সুরক্ষা ছিল। তবে সেসব ছাপিয়ে ঢুকে এসেছে জোয়ারের জল। আজ রাতে পূর্ণিমা ও ভরা কোটাল থাকায় আরও বেগতিক হতে পারে পরিস্থিতি সেই আশঙ্কাই করছেন গ্রামবাসীরা। ধানের ক্ষেত, পানের বরজ, মাছের ভেড়ি— সবই জলের তলায়। পানীয় জলের নলকূপেও ঢুকেছে নোনা জল। এমনকি গবাদি পশুদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে দড়ি। ৭৬-এর বন্যার পর আর এমন ঘটনার সাক্ষী থাকেনি সুন্দরবন। কোটি কোটি টাকার ক্ষতির মধ্যেই দাঁড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণবঙ্গ।
আরও পড়ুন
১৩৭ বছর আগে তোলা এই ছবিই ঘূর্ণিঝড়ের সর্বপ্রথম ফটোগ্রাফ
অন্যদিকে গরান বোস গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের পরিচালক নীহার রঞ্জন রপ্তান জানালেন, “মাতলা নদীর জলস্তর বৃদ্ধি পেয়ে প্লাবিত হয়েছে ক্যানিং-এর গ্রাম। কাকদ্বীপ, নামখানার অবস্থাও একইরকম।”
আরও পড়ুন
খরা, বন্যা কিংবা ঘূর্ণিঝড় - প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার দেশের অর্ধেক মানুষ
আর উদ্ধারকার্য? না, এখনও বিন্দুমাত্র হাত লাগানো যায়নি উদ্ধারকার্যে। কারণ, আজ রাত তো বটেই, আগামী দু-একদিনও রীতিমতো ফুঁসবে নদী। নতুন করে জল ঢুকবে গোটা অঞ্চলজুড়ে। ফলে বাঁধ কেটে জল বার করার সুযোগটাই নেই। এখন শুধু অপেক্ষার প্রহর বুনতে হচ্ছে তাঁদের। পরিস্থিতি ধাতস্থ হতে মাসখানেকও সময় লেগে যেতে পারে বলেই মনে করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। আর চাষের মাঠে এবং ভেড়িতে দীর্ঘদিন নোনাজল জমে থাকার কারণে তা আগামী তিন-চার বছর পর্যন্ত চাষের যোগ্য থাকবে না।
আরও পড়ুন
সোনা উপহার দিল ঘূর্ণিঝড়, অন্ধ্রের সমুদ্রতটে ভিড় গ্রামবাসীদের
বর্তমানে স্কুলবাড়িগুলিকে জরুরি তৎপরতায় আশ্রয়কেন্দ্র বানানো হয়েছে অনেক জায়গায়। পাথরপ্রতিমার দুটি স্কুলবাড়িতেই পৃথকভাবে গড়ে উঠেছে করোনার আইসোলেশন হোম। অক্সিজেনের অভাব তো ছিলই। আরও চরমে পৌঁছেছে সেই সংকট। পাশাপাশি ডায়েরিয়া, আমাশা-সহ জলবাহিত একাধিক রোগ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা। সেই পরিস্থিতির মোকাবিলায় সামান্য খড়কুটোটুকুও হারিয়েছে সুন্দরবন। কীভাবে পেরিয়ে ওঠা যাবে এই ক্ষতি? জানা নেই কারোরই…
Powered by Froala Editor