১৯০৩ সাল। ওড়িশা থেকে বাংলায় ছোটলাট অর্থাৎ লেফটেন্যান্ট গভর্নর হয়ে এলেন অ্যান্ড্রু ফ্রেজার। তবে শাসন করার আগে গোটা রাজত্বকে পরিদর্শন করে দেখার দরকার আছে বৈকি। সেই বাংলা পরিদর্শনে বেরিয়েই তিনি আবিষ্কার করলেন উপকূল ঘেঁষা ছোট্ট একটা গ্রাম। নারায়ণতলা। ‘রাজধানী’ কলকাতার একেবারে উল্টো ছবি সেখানে। মাইলের পর মেইল ফাঁকা সমুদ্রতট জুড়ে বিরাজ করছে নীরবতা। জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেলেন ফ্রেজার। ঠিক করলেন, সেখানেই গড়ে তুলবেন বিচ রিসর্ট। পাশাপাশি নিজের থাকার জন্যও বানাবেন বিলাসবহুল বাংলো।
রিসর্ট তৈরির পরিকল্পনা তাঁর সম্পূর্ণ হয়নি রাজত্বকালে। তবে স্বপ্নের সেই বাংলোকে যত্ন নিয়েই গড়েছিলেন অ্যান্ড্রু ফ্রেজার। বানিয়েছিলেন নারকেলের বাগান। গভর্নর ফ্রেজারের নাম অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে নারায়ণতলা হয়ে ওঠে ফ্রেজারগঞ্জ। ফ্রেজার সাহেবের তৈরি সেই বাংলোই ছিল পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। এবার ইয়াসের তাণ্ডবে সেই ঐতিহাসিক স্থাপত্যের অস্তিত্বই মুছে গেল সম্পূর্ণভাবে। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে নদীগর্ভে তলিয়ে গেল ফ্রেজার সাহেবের সেই বাংলো।
ফ্রেজারের রাজত্বকাল থেকেই ভূমিক্ষয়ের শিকার ছিল নারায়ণতলা। ফলে বাঁধ নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন স্বয়ং অ্যান্ড্রু ফ্রেজার। দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর ভাইকে। তবে ১৯০৮ সালে গভর্নর বদলের পর আর কোনো ব্রিটিশ শাসক উৎসাহী হয়নি এই অঞ্চলটির সংরক্ষণে। তার অন্যতম কারণ হল রাজধানী কলকাতা থেকে দূরবর্তী এই গ্রামে বসে বাংলা শাসন করা বেশ শক্ত কাজ। পরবর্তীতে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত হয় কলকাতা থেকে দিল্লিতে। তখন আরও যেন অন্ধকারে তলিয়ে যায় ফ্রেজারগঞ্জ।
যত সময় এগিয়েছে, ততই আগ্রাসী হয়েছে সমুদ্র। ভূমিক্ষয়ের মাধ্যমে ক্রমশ পরিধি বাড়িয়েছে সে। আর একটু একটু করে গিলে নিয়েছে ঐতিহাসিক এই বাংলোকে। তবুও অবশিষ্ট হিসাবেই টিকে ছিল কয়েকটিমাত্র ঘর। গতবছর আমফানে ধ্বসে পড়েছিল তারও একাংশ। শুধু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল দু’-চারটে দেওয়াল। এবার সেটুকুও ধুয়ে-মুছে গেল সমুদ্রস্রোতে।
আরও পড়ুন
বারবার ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত বাংলা, সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধিই একমাত্র কারণ?
সুন্দরবনের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ফ্রেজারগঞ্জ। ইয়াস আর ভরা কোটালের সাঁড়াশিচাপে বাঁধ পেরিয়ে সমুদ্রের নোনাজল ঢুকে পড়েছে লক্ষ্মীপুর, হাতিকর্নার, অমরাবতী ইত্যাদি অঞ্চলে। কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে ফাটলও। আর ফ্রেজার সাহেবের এই বাংলো একেবারে সমুদ্রতটে থাকায়, ন্যূনতম ঢালটুকুও পায়নি বিধ্বংসী জলোচ্ছ্বাসের সামনে।
আরও পড়ুন
বছরের পর বছর বিপর্যয় ‘টিকিয়ে রাখা’র শিকার সুন্দরবন?
তবে বাংলো থেকে খানিকটা দূরেই অতিথিদের জন্য আলাদা বাড়ি বানিয়েছিলেন অ্যান্ড্রু ফ্রেজার। সেই অতিথিশালার ভগ্নাবশেষ অবশ্য এখনও টিম টিম করে জ্বলে রয়েছে ইতিহাসের শেষ সাক্ষী হিসাবে। কিন্তু তাও বা আর কতদিন? এখন এই অতিথিশালাও প্রমাদ গুনছে ধ্বংসের। প্রতি বছর এক একটা ঘূর্ণিঝড় বাংলার বুকে আঘাত আনতে থাকলে, মুছে যাবে তার অস্তিত্বও।
আরও পড়ুন
ক্ষয়ক্ষতিতে আয়লা-আমফানকেও ছাপাল ইয়াস? আশঙ্কা সুন্দরবনকে ঘিরে
Powered by Froala Editor