জঙ্গলের মধ্যে রাতে শিকারিরা এসে গর্ত খুঁড়েছিল। আর তারপরেই সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে শতাব্দীপ্রাচীন কিছু যুদ্ধের সরঞ্জাম আর মানুষের হাড়। আরও কিছুটা মাটি খুঁড়তেই স্থানীয় ঐতিহাসিকরা খুঁজে পেলেন সেই সুড়ঙ্গের রাস্তা। যা এতদিন ধরে খুঁজছিলেন। এভাবেই সম্প্রতি ফ্রান্সের রেইমস শহরের কাছে উদ্ধার হল উইন্টারবার্গ টানেলের অস্তিত্ব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যে টানেলের ভিতরে বন্দি হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৭০ জনের বেশি জার্মান সেনা। তবে যুদ্ধের ব্যস্ততায় সেই সুড়ঙ্গের কথা দুই দেশই ভুলে গিয়েছিল।
সময়টা ১৯১৭ সালের গোড়ার দিকে। জার্মান ও ফ্রান্সের সীমান্ত সংঘর্ষ ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে। এই সময় জার্মান বাহিনী গোপন সুড়ঙ্গপথে ফরাসি বাহিনীর ঘাঁটিতে পৌঁছে আক্রমণের পরিকল্পনা করল। জঙ্গলের মধ্যে গোপনে শুরু হল সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ। আর তার অপর মুখ পৌঁছে যাবে ফরাসি ক্যাম্পের একদম কাছে। কিন্তু কোনোভাবে এই পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে যায় ফ্রান্স সরকার। রাতারাতি ফরাসি আর্টিলারি বাহিনী বোমা মেরে সুড়ঙ্গের দুটি মুখ বন্ধ করে দেয়। সুড়ঙ্গের মধ্যেই আটকা পড়ে যান দশম ও একাদশ বাহিনীর জার্মান সেনারা।
এর ৬ দিন পর অবশ্য ফরাসি সেনারাই সেখান থেকে তিনজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে। যুদ্ধের শেষে তাদের জার্মানিতে ফিরিয়েও দেওয়া হয়। কিন্তু এই ৬ দিনের মধ্যেই বাকিরা শ্বাসকষ্টে মারা যান। কেউ আবার সহযোদ্ধাদের বলেছিলেন তাঁদের হত্যা করতে। বিস্ফোরণের ধোঁয়ার মধ্যে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও আরামের। তবে ফরাসি বাহিনীর কাছে সেইসব মৃতদেহ মাটি খুঁড়ে বের করে আনা ছিল পণ্ডশ্রম। এরপর জার্মানি রেইমস শহর ও সংলগ্ন অঞ্চল দখল করলেও উইন্টারবার্গ টানেলের অনুসন্ধানের কোনো চেষ্টা করেনি। সরকারি স্তরে কোনোদিনই কোনো উৎসাহ দেখা যায়নি।
তবে ১৯৭০ সাল থেকেই উইন্টারবার্গ টানেল অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে দেন একদল স্থানীয় ঐতিহাসিক। কিন্তু খুঁজবেন কোথায়? কোনো সূত্রই তো হাতে নেই। প্রথম সূত্র পাওয়া গেল ২০০৯ সালে। জার্মানির বিশ্বযুদ্ধের নথি থেকে একটি মানচিত্র পাওয়া গেল, যাতে উইন্টারবার্গ টানেলের একটি নকশা রয়েছে। তবে সেই নকশা খুবই আবছা। দুর্বল গণনার উপর নির্ভর করে আঁকা। সেখান থেকে প্রকৃত অবস্থান খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু সেটাই একমাত্র সম্বল। ১০ বছর ধরে সেই মানচিত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছেন স্থানীয় ঐতিহাসিকরা। উভয় দেশের সরকারের কাছেই বারবার গবেষণায় সাহায্যের জন্য আবেদন জানালেও কেউ সাড়া দেননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের চেষ্টাতেই টানেলের সন্ধান পেলেন তাঁরা।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে রেকর্ড করা গান উদ্ধার গ্যারাজে
ইতিমধ্যে ২৭০ জন সেনার মধ্যে তিনজনকে শনাক্তও করতে পেরেছেন ঐতিহাসিকরা। তবে বাকিদের মৃতদেহ নিয়ে কী হবে, তার মীমাংসা হয়নি। ফ্রান্স বা জার্মানির সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। ঐতিহাসিকরা অবশ্য চাইছেন আরও গভীরে অনুসন্ধান করে প্রত্যেক সেনার কিছু গল্প খুঁজে আনতে। মৃত্যুর আগে কেউ কেউ ৬ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তাঁদের দৈনন্দিন সরঞ্জামও ছিল সুড়ঙ্গের মধ্যেই। হয়তো সেই মৃত্যুর মুখেই কেউ ডায়রি লিখেছেন। কেউ চিঠি লিখেছেন প্রিয়জনদের। ভেবেছেন তাঁদের মৃতদেহের সঙ্গে সেইসব চিঠি উদ্ধার করে হয়তো প্রিয়জনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। আজও যদি সেইসব নমুনার কিছু পাওয়া যায়, তাহলে যুদ্ধের সময়কার মানবিক টানাপোড়েনের গল্পগুলো জানা যাবে অনেকটাই।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের থেকেও বেশি কোভিডে মৃতের সংখ্যা! ভয়াল পরিস্থিতি আমেরিকায়