বেশিরভাগ রাজ্যেই ৪৫ ঊর্ধ্বদের টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়নি এখনও। তার মধ্যেই ভারত ঘোষণা করেছিল ১৪-৪৪ বছর বয়সীদের টিকাদানের কথা। তবে সার্বিকভাবেই মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারের সেই পরিকল্পনা। ১৮-ঊর্ধ্বদের টিকাকরণ বন্ধ অধিকাংশ রাজ্যতেই। যে রাজ্যগুলিতে এই পরিষেবা মিলছে, সেখানেও টিকা বুক করাই দায়। মুহূর্তের মধ্যেই ভর্তি হয়ে যাচ্ছে কোউইন অ্যাপের স্লট। অন্যদিকে হু-হু করে বেড়েই চলেছে সংক্রমণ। এই গোটা পরিস্থিতির জন্য সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং অবহেলার দিকেই এবার আঙুল তুললেন আন্তর্জাতিক গবেষকরা।
গোটা বিশ্বের মধ্যে ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশগুলির মধ্যে শীর্ষস্থানেই রয়েছে ভারত। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশজুড়ে প্রকট ভ্যাকসিন সংকট। আর তার দায় অনেকটা সরকারেরই। হিসাব বলছে, ভ্যাকসিনেশনযোগ্য নাগরিকের সংখ্যা ৯৬ কোটি। তার জন্য ন্যূনতম ১৯২ কোটি ডোজ বরাদ্দ করা দরকার। তা একবারে সম্ভব না হলেও, ধাপে ধাপে সেই লক্ষ্যমাত্রায় অনায়াসেই পৌঁছে যাওয়া যেত বলেই অভিমত গবেষকদের। তবে প্রথম থেকেই অবহেলা করা হয়েছে টিকাকরণের প্রক্রিয়াতে।
ভ্যাকসিন বাজারে আসার মোটামুটি এক বছর আগে থেকেই দেশের জন্য ভ্যাকসিনের প্রি-বুকিং করে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলি। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভারত ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করে ভ্যাকসিন অর্ডারে। যার ফলে মাত্র ৩৫ কোটি ডোজ এখনও পর্যন্ত হাতে পেয়েছে ভারত সরকার। যা দিয়ে মাত্র ২০ শতাংশ নাগরিকদের টিকাকরণ সম্ভব। অ্যাক্সেসআইবিএসএ সংস্থার সমন্বয়কারী অচল প্রভালা’র অভিমত ভাইরাসের সংক্রমণ অক্টোবরের পরে কমে যাওয়ার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ধরে নেওয়া হয়েছিল ভাইরাসের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক অনাক্রম্যতা অর্জন করেছে দেশের মানুষ। পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরালো করতে, একাধিক দেশে ভ্যাকসিন রপ্তানি করা হয়। যা আরও বাড়িয়ে তোলে সংকটকে।
দ্বিতীয় তরঙ্গের আঘাত হানার পর অবশ্য নড়ে-চড়ে বসে ভারত সরকার। ভারত বায়োটেক এবং সিরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বরাদ্দ করা হয় ৬১ কোটি মার্কিন ডলার। তাছাড়াও তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে কোভ্যাক্সিন তৈরির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে আগে থেকেই কি এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেত না? তার বদলে, মহামারীর বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে নেওয়া গেছে— এমনই অন্ধবিশ্বাস আঁকড়ে বসেছিল ভারতের প্রশাসনিক নেতারা।
আরও পড়ুন
মজবুত করতে হবে গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, করোনা-মোকাবিলায় নিদান চিকিৎসকদের
তবে ভ্যাকসিন উৎপাদনে সেরাম ইনস্টিটিউটের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে। উঠছে জালিয়াতির অভিযোগ। গেটস ফাউন্ডেশন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স প্রকল্পের আওতায় মোট ৩০ কোটি মার্কিন ডলারের অনুদান পেয়েছিল ভারতীয় সংস্থাটি। চুক্তি হয়েছিল উৎপাদিত ভ্যাকসিনের ৫০ শতাংশ দরিদ্র দেশগুলিতে বিনামূল্যে পাঠাবে তারা। তবে মানা হয়নি সেই চুক্তি। এমনকি কীভাবে খরচ হয়েছে এই ৩০ কোটি ডলার— তার হিসেবও দিয়ে উঠতে পারেনি সেরাম ইনস্টিটিউট।
আরও পড়ুন
কলকাতা ও শহরতলিতে অক্সিজেনের কালোবাজারি চরমে, সাক্ষী খোদ ভলেন্টিয়াররা
এমত পরিস্থিতিতে ১৮-৪৪ বছর বয়সীদের টিকাকরণের সিদ্ধান্ত নিয়ে আরও বড়ো ভুল করেছে ভারত। এমনটাই অভিমত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডঃ অনন্ত ভানের। আগে ৪৫-ঊর্ধ্বদের টিকাকরণ শেষ করার পরই, এই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করছেন তিনি। তাহলে অন্তত চরমে পৌঁছাত না ভ্যাকসিনের চাহিদা। পাশাপাশি ভ্যাকসিন বুকিং-এর জন্য সরকারের ডিজিটাল পথে হাঁটাকেও দুষেছেন তিনি। স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের সুবিধা নেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ফলে তাঁরা সম্মুখীন হচ্ছেন হয়রানির। আর এই সুযোগে চলছে ভ্যাকসিন নিয়েও কালোবাজারি।
আরও পড়ুন
কনসেন্ট্রেটর থেকে সিলিন্ডার – অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে তৈরি শহরের তরুণ প্রজন্ম
১ মে থেকে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা টিকাকরণ চালু করার পর থেকেই দাম বেড়েছে ভ্যাকসিনের। যেখানে সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কেন্দ্রের চুক্তিবদ্ধ দাম ছিল ২ ডলার, তা এখন পৌঁছেছে দ্বিগুণে। কোভ্যাক্সিনের দাম ৮ ডলার। অর্থাৎ, ছ’শো টাকা। সম্প্রতি অনুমোদন পেয়েছে রাশিয়ান ভ্যাকসিন স্পুটনিক ভি। বাজারে তার দাম আরও বেশি। আনুমানিক ১৫০০ টাকা।
এই মুহূর্তে সরকারের ওপর ভরসা না করেই একাধিক রাজ্য জনসন অ্যান্ড জনসন, মডার্না এবং ফাইজার ভ্যাকসিন আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ভারতে এসে পৌঁছাবে সেগুলি— তার হদিশ নেই কোনো। কেন না, প্রতিটি কোম্পানিই এখন প্রি-অর্ডার সরবরাহ করতে ব্যস্ত। এখানেই প্রশ্ন উঠে আসছে, কেন্দ্র সরকারই কি প্রথম থেকে এই পদক্ষেপ নিতে পারত না? বদলে মাত্র দুটি সংস্থার ভ্যাকসিনের ওপরেই কেন ভরসা করে আসা প্রথম থেকে? এই মুহূর্তে দেশীয় ফার্মা সংস্থাগুলির ক্ষমতায়ন করে খানিকটা হলেও পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা যেতে পারে বলেই আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা। এখন দেখার, সেই পথেই হাঁটে কিনা কেন্দ্র…
Powered by Froala Editor