সাহিত্যজগতে নক্ষত্রপতন, প্রয়াত হাসান আজিজুল হক

শুধু সাহিত্যিক বললে হয়তো সঠিক পরিচয় দেওয়া হয় না তাঁর। সাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য, মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরব হতে কোনোদিনও আপোষ করেননি তিনি। হাসান আজিজুল হক (Hasan Azizul Huq)। বাংলা সাহিত্যজগতের অন্যতম কথাশিল্পী পাড়ি দিলেন অনন্তের দিকে।

বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। মাস কয়েক আগে ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালেও। বাড়ি ফিরলেও, সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠা হয়ে উঠল না আর। আজ স্থানীয় সময় রাত ৯টা নাগাদ নিজের বাসভবনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হাসান আজিজুল হক। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

জীবনের অধিকাংশ সময় পূর্ববঙ্গে কাটলেও, হাসান আজিজুল হকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। ১৯৩৯ সাল সেটা। তার ঠিক পর পরই দেশভাগের ছায়া নেমে আসে ভারতের বুকে। বাংলার মাঝখান দিয়ে উঠে যায় কাঁটাতারের বেড়া। সেসময়ই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে হয়ে উঠেছিলেন পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা। ১৯৫৮ সালে রাজশাহী রাজশাহী কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতকতা করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন স্নাতকোত্তর বিভাগে। পরবর্তীতে দর্শনে গবেষণার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় গেলেও, সেখানকার পরিবেশ ভালো না লাগায় বাংলায় প্রত্যাবর্তন। সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ তারপরেই। ব্যক্তিগত লেখালিখির পাশাপাশি অস্থির সময়ের কথাও উঠে আসত তাঁর কলমে। আসলে ছাত্রজীবন থেকেই যে তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। এমনকি প্রতিরোধের জন্য পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতেও নির্যাতিত হতে হয়েছিল তাঁকে। 

ষাটের দশকে রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ব্রজলাল সরকারি কলেজ-সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৩ সালে থিতু হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৪ সাল পর্যন্ত একটানা ৩১ বছর সেখানেই অধ্যাপনা করেছেন হাসান আজিজুল হক।

ছ’দশকের সাহিত্যজীবনে গল্প, প্রবন্ধ উপন্যাস মিলিয়ে লিখেছেন চল্লিশটিরও বেশি বই। যার মধ্যে রয়েছে ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘আমরা অপেক্ষা করছি’, ‘চালচিত্রের খুঁটিনাটি’, ‘অপ্রকাশের ভার’-এর মতো গল্প ও প্রবন্ধের সংকলন। তাঁর লেখায় বার বার উঠে এসেছে রাঢ়বঙ্গের ছবি। ‘শিউলি’, ‘আগুনপাখি’, ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ এবং ‘শামুক’— তাঁর চারটি উপন্যাসই প্রকাশিত হয়েছে চলতি শতকে। যদিও উপন্যাসের জগতে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ষাটের দশকেই। ১৯৬০ সালে ‘বৃত্তায়ন’ লেখার মধ্যে দিয়ে। তবে ‘বৃত্তায়ন’-কে উপন্যাসের তকমা দিতে চিরকালই আপত্তি ছিল তাঁর। এমনকি এই উপন্যাসের প্রকাশ্য সমালোচনাও করেছেন তিনি নিজেই। সাহিত্যসৃষ্টির প্রতি এই সততা বা নিষ্ঠা এককথায় বিরল বললেই চলে।

২০০৮ সালে ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের জন্য কলকাতা বইমেলায় আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হন আজিজুল হক। তাছাড়াও সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য ঝুলিতে রয়েছে সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, ক্রান্তি পদক, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার-সহ একাধিক সম্মাননা। 

শুধু গ্রন্থনির্মাণই নয়, একাধিক গ্রন্থের সম্পাদনাও করেছেন হাসান আজিজুল হক। অভিভাবকের ছায়া দিয়েছেন তরুণ প্রজন্মকে। কিংবদন্তি সাহিত্যিকের প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যজগত হারাল তার অন্যতম মহীরুহকে। ঠিক এক বছর আগে এই দিনই চলে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্রজগতের তারকা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এবার আরও এক নক্ষত্রপতনে শোকস্তব্ধ দুই বাংলাই…

Powered by Froala Editor