এই তো লকডাউন শুরুর সময়, দেবেশদার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, ফোনে। ভয় পেয়েছিলেন; চিন্তা করছিলেন; আমি সাহস জোগালাম; বললাম, আমাদের দেশের মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা বেশি। ফলে, অতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়তো হবে না। শুনে বললেন, না হলেই ভালো। তারপর জানতে চাইছিলেন, এই অবস্থায় কী করছি? বললাম, বই পড়ছি। সিনেমা দেখছি। বললেন, ওঁরও খুব সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে। জানতে চাইলেন, কোথায় ছবি দেখছি? বললাম, ইউটিউবে। উনি ইউটিউব খুলতে পারেন না। বললাম, কাউকে বলুন খুলে দিতে; সিনেমা দেখলে ভালো লাগবে। সেদিন আরও অনেক হল। শেষে বলেছিলেন, আবার ফোন করব। কথা হবে...
কথা তো কত-ই হয়েছে। আজ কত কত কথা মনে পড়ছে তার ঠিক নেই। দেবেশদা চলে গেছেন, এ-কথা শোনার পর থেকেই অস্থিরতা অনুভব করছি। কাঁদছি। রাতে উঠে কিছু লিখেও ফেলি, না-লিখে থাকতে পারছিলাম। দেবেশদা এতটাই আমার সমগ্র ছুঁয়ে আছেন। আমার গদ্য, লেখা বা ভাবনার সঙ্গে দেবেশদার যে খুব মিল আছে, এমনটা বলব না। কিন্তু আমার উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে রুশ সাহিত্য আর দেবেশদার লেখার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আমি ওঁর লেখা পড়ে পড়ে শিখেছি। উনি নিজের লেখাতেও রুশ সাহিত্যের ধারা বহন করতেন। আর আমাদেরও পড়াশোনার মধ্যে এই রুশ সাহিত্যের একটা বড়ো জায়গা আছে। একরকমের চালু মত আছে যে, বেশি লিখলে লেখার মান পড়ে যায়। অথচ, দেবেশদা কত বড়ো বড়ো উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে এ-কথা বলা তো দূরের কথা, ভাবাও যায় না। কী অসামান্য সব উপন্যাস লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাথায় রেখেও বলছি, দেবেশদার মতো বড়ো মাপের ঔপ্যনাসিক বোধহয় আমাদের সাহিত্যে আসেনি। এটা আমার একান্ত বিশ্বাস।
দেবেশদা তাঁর সাহিত্যে একক এবং স্বতন্ত্র। আমি জানি না, এর কোনো ধারা হয় কি না। অর্থাৎ, কেউ দেবেশদার ধারায় লিখবেন কি না, বা লিখতে সমর্থ হবেন কি না। আমার নিজের মনে হয়, তা হওয়াও উচিৎ নয়। প্রত্যেক লেখকই তাঁর নিজের মতো করে লিখবেন। কিন্তু একটা ব্যাপার ধ্রুব যে, আমাদের রক্তের মধ্যে পিতৃপুরুষের ছায়া থেকে যায়। আমার মুখের রেখায়, কথায়, যাপনে কোথাও-না-কোথাও আমার পিতৃপুরুষরা আছেন। আবার, আমার সন্ততিদের ক্ষেত্রেও তা সত্যি হবে। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার। নির্দিষ্ট কোনো ধারা হয় কিনা, তা নিয়ে হয়তো অনেক আলোচনা চলতে পারে। কিন্তু একজন পাঠক, তাঁর স্বদেশকে চিনতে পারবেন না, যদি না সে দেবেশদার সাহিত্য পড়ে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে যদি কেউ না পড়েন, সেখানেও একই কথা প্রযোজ্য। এঁরা আমাদের অগ্রজ। এঁরা আমাদের শিখিয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন। সাহিত্যই তো স্বদেশকে চেনায়। নইলে কে চেনাবে! মিডিয়া তো চেনায় না। নিজের দেশকে জানতে গেলে তাই নিজের দেশের সাহিত্যের কাছে বসতে হবেই। ভবিষ্যতের প্রতিটি পাঠককে তাই দেবেশদার সাহিত্যের কাছে আসতে হবে।
যখন ‘কথা সোপান’-এর সম্পাদনা করেছি, তখন প্রতি পুজোসংখ্যায় দেবেশদার লেখা ছেপেছি। তাঁর সম্পাদনাতে লিখেওছি। আমি ২৬-২৭ বছর বয়স থেকে উপন্যাস লিখতে শুরু করি। ২৮-এ ধারাবাহিক লিখি। তখন বাইরে বাইরে চাকরি করতাম। ফলে দেবেশদার সঙ্গে যোগাযোগ কম-ই হত। একবার, আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের নাট্যোৎসবে গেছি। দেখি, দেবেশদা ডাকছেন। জিজ্ঞেস করছেন, কোথায় আছি? বললাম, বাঁকুড়ায় ছিলাম, এখন ফিরে এসেছি। তখন বললেন, প্রতিক্ষণ-এর জন্য একটা উপন্যাস লিখতে। আমি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি। সেবার লিখলাম, ‘হাঁসপাহাড়ি’। তারপর লাতুরের কিল্লারি গ্রামে যাই। ভূমিকম্প বিধ্বস্ত এলাকা। ফেরার পর, প্রতিক্ষণ-এর সম্পাদক স্বপ্না দেব আমায় বললেন, একটা রিপোর্ট লিখতে। দেবেশদা পাশেই ছিলেন; বললেন, ও রিপোর্ট কেন লিখবে? বরং যা দেখে এসেছে, তার উপর ভিত্তি করে উপন্যাস লিখুক। লিখলাম, ‘নিসর্গের শোকগাথা’। দেবেশদা পড়ে ভারী খুশি হলেন; ছেপেছিলেন সে-লেখা। এই সেদিনও আমার ‘মোমেনশাহী উপাখ্যান’ পড়ে ফোন করলেন। জানালেন, তাঁর তো ভালো লেগেইছে; আমিও আমার লেখকজীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ হয়তো করে ফেলেছি। দেবেশদার থেকে পাওয়া এ-কথার গুরুত্ব যাঁরা জানেন, তাঁরা-ই জানেন। দেবেশদা যেমন তাঁর অগ্রজের লেখা পড়তেন, তেমন তরুণদের লেখাও মন দিয়ে পড়তেন। এইটা ছিল তাঁর মস্ত গুণ।
এই ৮৪ বছর বয়সেও লিখে চলেছিলেন। নিজেকে পালটাচ্ছিলেন, নিজের লেখা কাটাছেঁড়া করছিলেন। ‘ইউসুফ ও জুলেখা’র প্রথম পর্ব পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। বললাম, দেবেশদা শেষ করুন। বললেন, হ্যাঁ লিখছেন। প্রথমবারের অনেকগুলো জায়গা ওঁর পছন্দ হয়নি, সেগুলো আবার নতুন করে লিখছেন। এটাই দেবেশদা। নিয়ত নিজেকে নিরীক্ষা করা, লেখক হিসেবে তাঁর ধর্ম। তিনি একদিনও তা থেকে সরে যাননি। তাঁর সাহিত্য তাই স্বদেশ ও সময়ের ইতিহাস হয়ে উঠেছে। নিজের ইতিহাসকে জানতে গেলে তাঁর সাহিত্যের সমীপবর্তী আমাদের হতেই হবে।
শেষ যেদিন ফোনে কথা হল, সেদিন বলেছিলেন, আবার ফোন করব...। দেবেশদার সঙ্গে আর ফোনে কথা হল না। এবার তাঁর লিখিত অক্ষর আর স্মৃতির সঙ্গেই আমার কথোপকথন চলবে।
(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)