ডিয়ার লিওনেল,
আর্জেন্টিনায় স্প্যানিশ দৌরাত্ম্য পেরিয়ে কোনোদিন বাংলাভাষা পৌঁছাবে না। তবু ছেলেবেলা থেকে দেখে আসা একটা বাংলা সিনেমার সঙ্গে ২০১১-এর সেই সম্মোহনী রাতের খুব মিল পাচ্ছিলাম।
গুপীবাঘার আশ্চর্য গানের সময় সম্মোহিত হয়ে যেত শ্রোতারা। নড়ে না। চড়ে না। শুধু চুপ করে শুনে যায় সেই সুর। সেখানে এসে ভিড় করে কখনো স্নিগ্ধতা, সে সুরে কখনো থাকে প্রতিবাদ, কখনো প্রেম, কখনও জীবন, কখনও প্রকৃতি - তবু বহুরূপেই সে সম্মোহনী। ওয়েম্বলির বিখ্যাত ফাইনালে সবাই হতবাক হয়ে গেলেও থরথর করে কাঁপছে স্যার আলেক্স ফার্গুসনের আঙুল। সারা পৃথিবীর কাছে ত্রাস হয়ে ওঠা ফার্গুসনের ম্যাঞ্চেস্টারকে গুপীবাঘার গানের মতো সম্মোহিত করে রেখে দিয়েছ তুমি। ম্যাচের পর আলেক্স তোমায় বলেছিলেন, এই ছেলেটি অন্য গ্রহের মানুষ নিশ্চিত...
ফুটবলে কিছু জিনিস খুব চর্চার বিষয় হিসেবে উঠে আসে। গোল-স্কিল-টেম্পারমেন্ট-রেকর্ড। এই চারের কোথাও মেসি নামক বিস্ময় যেন থেকেও নেই।
আরও পড়ুন
প্রতি ৬ সেকেন্ডে সাফ হচ্ছে ফুটবল মাঠের সমান বনভূমি, সাম্প্রতিক গবেষণায় চাঞ্চল্য
যদি প্রচুর গোল করে ফুটবলে রাজত্ব করতে হত তাহলে তো মিরোস্লাভ ক্লোজে, রোনাল্ডো নাজারিও ছিলেন, যদি অফুরান স্কিলের ফুলঝুড়ি দিয়ে হাততালি আদায় করে নিতে হত তাহলে তো রোনাল্ডিনহো ছিলেন, যদি একা হাতে ম্যাচের রং পালটে দিতে হত তাহলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডা আছেন, যদি ইতিহাসের বন্দিত নায়ক হতে হত তাহলে মারাদোনা রয়েছেন, যদি আজন্ম বুকে রেকর্ডবোর্ড নিয়ে বাঁচতে চাইতাম তাহলে কসমসের ব্ল্যাক ডায়মন্ড ফুটবল সম্রাট পেলে ছিলেন, বিশ্বজুড়ে কত খেলোয়াড় - কিন্তু তুমি তো কোত্থাও ছিলে না লিওনেল মেসি...
আরও পড়ুন
প্রত্যাবর্তন স্প্যানিশ ফুটবলের, ১১ জুন থেকে শুরু হতে চলেছে লা লিগা
তবু তোমার জন্মদিনেই কেন ইউনিসেফ হাজার হাজার খেতে না পাওয়া বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেবার কথা ভাবে? তোমার জন্মদিনেই কেন পৃথিবীতে ১৪৫টির বেশি আন্তর্জাতিক-জাতীয় ও বেসরকারি সংস্থা যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে শিশুদের শিক্ষার জন্য তাঁদের এজেন্ডা চালু করল? ফুটবলে নিজের কেরিয়ার তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টাতে, ২০০৭ সালে, কেন ‘লিও মেসি ফাউন্ডেশন’ তৈরি করে অসহায় বাচ্চাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলে? কেন ইউনিসেফ তাঁদের গুডউইল অ্যাম্বাসাডারে তোমাকে রাখে এক যুগ ধরে? কেন ভ্যাল ডি হ্যাব্রনের ইউনিভার্সিটি হাসপাতেলের শিশুদের জন্য তুমি নিজের খেলার অবসর সময়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কিডস পার্ক বানালে?
আরও পড়ুন
তিনটে পা ও ১৬টি আঙুল নিয়েই আমেরিকা মাতিয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক, শিখেছেন ফুটবলও
তোমার জন্মদিনেই কেন সুদূর কলকাতায় একদল ছেলেমেয়ে অনাথ শিশুদের একদিন কেক-চকোলেট নিয়ে থাকার আয়োজন করল?
আরও পড়ুন
দু’মাস পরে মাঠে ফিরছেন ফুটবলাররা, আজ থেকে শুরু বুন্দেশলিগা
ফুটবলে একটা কথা রয় হাডসন ঢুকিয়ে দিয়েছেন। 'Bird of paradise fluffering his wings' - স্বর্গের পাখি! রোজারিও-র সকালে তোমার যখন ঘুম ভাঙত সকলে দেখত রাতে ফুটবলটাকেই জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেছ তুমি। এই ফুটবল সাম্রাজ্যে রাজত্ব করেছেন কত কত সম্রাট, তাঁদের রণহুঙ্কারে কেঁপে উঠেছে মারাকানা থেকে ওয়েম্বলি; কিন্তু তুমি কোনোদিন শাসক হতে চাওনি। প্রেমিক হতে চেয়েছিলে। স্প্যানিশ মিডিয়া খুব ছোটো থেকে তোমার সম্পর্কে লেখার সময় একটা কথা খুব ব্যবহার করত - রাজপুত্র!
আরও পড়ুন
‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার’ তিনি, জীবনের মতো মৃত্যুকেও ঘিরে রাখলেন নীরবতায়
এই তকমা এর আগে পেয়েছিলেন তোমার দেশেরই একজন। খুব প্রিয় এক ফুটবল বিশ্লেষক বলছিলেন - ওই সাদা বলটাকে কোনোদিন মেসি ফুটবল ভাবেনি, নিজের ভালবাসা ভেবেছিল, নইলে কারও ফার্স্টটাচ এত নরম, এত ঐশ্বরিক শান্ত হতে পারে না। পায়ে বল পড়লেই সবকিছু হাডসনের কমেন্ট্রির মতো ম্যাজিক, কোনো ঔদ্ধত্য নেই, যেন অপার স্নিগ্ধতা স্প্রে করছে কেউ সবুজ গালিচা থেকে, সে-মাঠ তখন অ্যাস্থেটিক্সের ক্লাস নিতে পারে যেন...
আরও পড়ুন
চুণীর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ফুটবল জগৎ; স্মৃতিচারণায় প্রশান্ত, মেহতাব থেকে শিল্টন
২০০৭-এ আমার স্বপ্নের ছোট্ট ১৯ বছরের ছেলেটা যে বাঁ-পায়ের শটে ক্যাসিয়াসের পাশ দিয়ে হ্যাট্রিকের গোলটা করার পর অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিল গাউচোকে, পিঠে হাত বুলিয়ে যেন সেদিন একটা আগুনকে শান্ত করেছিল গাউচো, হয়তো বলেছিল – ‘এই আগুনটা বাঁচিয়ে রাখ লিও, তোকে যে অনেকদিন একটু একটু করে জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যেতে হবে এই আগুনে, এই বিশ্বকে ফুটবলের আলো দেখানোর জন্য টিকে থাকতে হবে অনেকগুলো দিন...’
বেলা পড়ে এল, এখন ২৪ জুন এলে বুকের বাঁ-পাশটা খালি খালি লাগে, মনে হয় আরও অনেক বছর পর কেউ যদি জিজ্ঞেস করে এই মানুষটার কথা একটু গর্ব করে বলব - এই সেই মানুষ যে বিশ্বকাপ ফাইনালে আমাকে কাঁদিয়েছিল, এই সেই মানুষ যে চারবার ফাইনালে উঠে ফাইনালে পেনাল্টি মিস করে কেঁদেছিল, এই সেই মানুষ যার কান্না দেখার জন্য তাকিয়ে থাকত চারপাশের অনেকে, এই সেই মানুষ যে এ জীবনে সবচেয়ে বেশিবার বুকে জমাট ব্যথা দিয়ে গেছে... বলতে বলতে চোখের কোল ভিজে যাবে হয়তো সেদিন, হয়তো শেষে বলে উঠতে পারব না যে এই সেই মানুষ যে আমাকে প্রতিবার হেরে যাবে জেনেও জীবনের একটার পর একটা লড়াই-এর ময়দানে নামতে শিখিয়েছে...
আর তো কয়েকটা দিন, সময় হয়ে এল, সবুজ গালিচা ছেড়ে তুমি বেঁচে থাকবে হাজার হাজার শিশুদের মধ্যে, খেলবে, গান গাইবে, আমরা কাঁদব, আনন্দে!
তখনও আমার কাছে এ প্রশ্নের কোনো উত্তর থাকবে না যে কেন এত যন্ত্রণা পাবার পরেও, এত আন্তর্জাতিক মঞ্চে চর্চিত ব্যর্থতার পরেও ফুটবলের অন্যতম জনপ্রিয় খেলোয়াড়ের নাম লিওনেল মেসি, কেন মিডিয়াপ্রিন্টের পাতাজুড়ে মারাদোনার পরে সবচেয়ে বেশি মহাকাব্য লেখা হয়েছে রোজারিওর এই মানুষটাকে নিয়ে। ভালবাসা একটা অসমাপ্ত প্রশ্ন যার উত্তর খুঁজতে চাওয়া বোকামি...
তুমি বড়ো ফুটবলার লিওনেল, কিন্তু সময়টাকে ড্রিবল করে থমকে দিতে পারছ না, নীল গোলকের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা হয়েও এই যা তোমার সীমাবদ্ধতা...
শুভ তেত্রিশতম জন্মদিন লিওনেল,
ভালো থেকো!
Powered by Froala Editor