“কেউ যখন আত্মহত্যা করেন, তখন তার কারণটিও সেই মানুষটির সঙ্গেই পৃথিবী থেকে চলে যায়। আমরা খুব নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, ঠিক এই কারণেই ঘটল। বহু সময়ে আমাদের চারপাশের চাপকে এতটা আত্মীকরণ করে ফেলি, তখন সেই চাপটা আমাদের ভেতর থেকেই তৈরি হতে থাকে। অনেক সময় আত্মহত্যার ক্ষেত্রে একটা তাৎক্ষণিকতা কাজ করে। এবং সেক্ষেত্রে ঠিক যেটা চাইছিলাম, যেভাবে চাইছিলাম, সেটাই পাওয়া মানে জীবনের অর্থ— এমনটা মনোভাব মানুষকে তাড়িত করে, যে সেখান থেকে মানুষ নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন।”
বলছিলেন মনবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সে, গত পরশুই পৃথিবীকে বিদায় জানালেন কুস্তিগির রীতিকা ফোগট। বেছে নিলেন আত্মহননের পথ। সম্প্রতি রাজস্থানের ভরতপুরে আয়োজিত একটি কুস্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন রীতিকা। আর তার পরেই এমন ঘটনা। ফাইনালে এক পয়েন্টের জন্য হেরে যাওয়াই আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে তাঁকে, এমনটাই অনুমান করছেন পরিবারের সদস্যরা।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে পড়াশোনা হোক অথবা চাকরি— সমস্ত ক্ষেত্রই যেন হয়ে উঠেছে ‘প্রতিযোগিতা’-র ময়দান। এই প্রতিযোগীতা শুধু সহকর্মী কিংবা সহপাঠীদের সঙ্গে নয়। বরং বৃহত্তর দিকে দেখতে গেলে পরিবারিক সাফল্যের এবং নিকট আত্মীয়দের সঙ্গেও প্রতিনিয়ত তুলনা করা হয় অধিকাংশ কিশোর-কিশোরী কিংবা যুবক-যুবতীদের। যা বাড়তি অবসাদ কিংবা মানসিক চাপের দিকেই ঠেলে দেয় তাঁদের। আধুনিক নগর সভ্যতার অভিশাপ বললেই চলে এই মানসিকতাকে।
রীতিকার ক্ষেত্রেও কি সেই ঘটনাই ঘটেছিল? উঠে আসছে তেমন সম্ভাবনাই। ‘দ্রোণাচার্য’-জয়ী মহাবীর সিং ফোগটের পরিবারেরই সদস্য রীতিকা। তাঁর কাছেই অনুশীলন করতেন সদ্য-প্রয়াত তরুণী। পাশাপাশি সম্পর্কে জাতীয় কুস্তিগির গীতা এবং ববিতা ফোগটের তুতো বোন তিনি। গীতা-র সৌজন্যেই প্রথমবার কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পেয়েছিল ভারত। ভারতীয় কুস্তিতে ফোগট পরিবারের অবদান উঠে এসেছে বার বার। বছর কয়েক আগে প্রকাশিত ‘দঙ্গল’ চলচ্চিত্রেও দেখা গিয়েছিল ফোগট পরিবারকে।
আরও পড়ুন
নাটকের নামেই ‘ধর্মীয় ভাবাবেগে’ আঘাত! মধ্যপ্রদেশে বন্ধ হল নাট্যোৎসব
সেই কারণেই হয়তো রীতিকার ভার বাড়িয়ে দিয়েছিল পরিবারের প্রত্যাশা। ন্যুব্জ করে দিয়েছিল রীতিকাকে। বিগত কয়েকবছর ধারাবাহিকভাবেই রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন তিনি। রয়েছে বেশ কয়েকটি পদকও। তবে দিদিদের সমান উচ্চতায় পৌঁছানোর চাপ কি তবে ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছিল তাঁকে? আর তাতেই কি ঘৃতাহুতি দিল সাম্প্রতিক পরাজয়? এমন প্রশ্নই উঠে আসছে বার বার।
“রীতিকা যেহেতু ক্রীড়াজগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই তার পারফর্ম্যান্স, জেতা-হারা আরও অনেক মানুষের চোখে পড়বে। ফলে নিশ্চয়ই তাঁর চাপটা হয়তো অন্য ছিল। তবে আমার মনে হয় সামগ্রিকভাবে জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিটাকে যদি আমরা বিস্তৃত করতে পারি, তাহলে ওই একটা জেতা-হারা দিয়ে, একটা পাওয়া-না পাওয়া দেখে জীবনে হাতটা হয়তো ছাড়ব না”, জানালেন অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন
মার্চেই বন্ধ হচ্ছে টেকিপ, অনিশ্চয়তার মুখে দেশের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা
চলচ্চিত্র হোক কিংবা সঙ্গীত— সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক তারকাকে হারিয়েছে ভারত। প্রতিক্ষেত্রেই ঘাতক হয়ে দাঁড়িয়েছে অবসাদই কিংবা মানসিক অবস্থাই। হয়তো পরিপার্শ্বের মানুষজন আরও একটু সহানুভূতিশীল হলে ঘটত না এমন অঘটন। কাজেই এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে এগিয়ে আসতে হবে গোটা সমাজকেই, তা বলার অপেক্ষা থাকে না…
Powered by Froala Editor