বিপক্ষের রণকৌশল জানতে পারলে অনেকটাই হাতের তালুতে চলে আসে যুদ্ধ। আর সে যদি বিশ্বযুদ্ধ হয়, তবে তো কথাই নেই। সেই উদ্দেশ্যেই পোলিশ সেনাশিবিরে গুপ্তচর পাঠিয়েছিল মুসোলিনির বাহিনী। পরনে মৃত ইহুদি সেনার পোশাক। ফলত, দৃষ্টি এড়িয়ে ছাউনিতে ঢুকতে অসুবিধা হয়নি। হাতের মুঠোয় চলে এসেছিল খবরাখবরও। কিন্তু সমস্যা বাঁধল ফেরার সময়। বিপক্ষের সেনাদের আসতে দেখে ইতালির সেই গুপ্তচর আত্মগোপন করলেন ত্রিপল টাঙানো স্নানঘরে। তারপরই ঘটে গেল এক আশ্চর্য ঘটনা। টেনেহিঁচড়ে দরজা খুলে স্নানঘরে ঢুকে পড়ল প্রকাণ্ড এক ভালুক। ভয়ঙ্কর এই দৃশ্য দেখে ‘আইয়ুতামি, আইয়ুতামি’ বলে তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন তিনি। ততক্ষনে জড়ো হয়েছেন পোলিশ সেনারা। ইতালিয়ান ভাষায় ‘বাঁচাও’ শুনে গুপ্তচরের পরিচয় বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারোরই। অতএব বাধ্য হয়েই আত্মসমর্পণ করেন ইতালির চর।
না, কোনো সিনেমা বা উপন্যাসের গল্প নয়। বাস্তবেই ঘটেছিল এমনটা। সেনাবাহিনীতে কুকুরের ব্যবহার হয় আজও। এক সময় ব্যবহৃত হত পায়রা, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি বন্য প্রাণীর। কিন্তু ভালুক? এমন উদাহরণ বিরল বললেই চলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তেমনই রূপকথার আখ্যান তৈরি করেছিল ওজটেক। ৫০০ পাউন্ডের এই পোষ্য ভাল্লুকই হয়ে উঠেছিল পোলিশ সেনাবাহিনীর অন্যতম জয়ের নায়ক।
আরেকটু আগে থেকেই শুরু করা যাক। ১৯৪১ সাল। পোল্যান্ড একদিকে তখন জার্মান অধিগ্রহণের শিকার, অন্যদিকে অসংখ্য ইহুদি সেনাকে বন্দি করেছে স্তালিনের বাহিনী। তবে যুদ্ধ যখন ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে, তখন ভোল বদলালেন স্তালিন। পোলিশ সেনাদের কাছে প্রস্তাব দিলেন, জার্মানির বিরুদ্ধে লড়াই করলে বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ড স্বাধীনতা দেবেন তিনি। সেই মতো স্বাক্ষরিত হল চুক্তি। ঠিক হল মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে হানা দেবে পোলিশ সেনারা। হলও তেমনটা।
আরও পড়ুন
হিরোশিমার থেকেও ৩০০ গুণ শক্তিশালী বোমা আছড়ে পড়ল আমেরিকার বুকে; তারপর?
সেই যাত্রাপথেই পোলিশ সেনাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে ওজটেক। ইরানে পোলিশ বাহিনীর সেকেন্ড কর্পসের সেনানী ওয়াসেজিচ নরবক্সি ইরানে খুঁজে পান তাকে। তখন অবশ্য নিতান্তই শাবক সে। পাশেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল তার মা। অসহায়তার এই দৃশ্য দেখে এড়িয়ে যেতে পারেননি ওয়াসেজিচ। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখেই তিনি ভালুক শাবকটির নাম রাখেন ওজটেক। তাঁর পোষ্য হিসাবেই যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হয় সে।
আরও পড়ুন
সিন্থেটিক ড্রাগে অভ্যস্ত ছিল নাৎসি সেনারা, ‘নেশা’র অভাবেই আত্মহত্যা হিটলারের?
তবে বছর দুয়েকের মধ্যে ছোট্ট ওজটেকের আয়তন হয়ে দাঁড়ায় ১০ ফুট। তার ওজন তখন প্রায় ৫০০ পাউন্ড। কিন্তু দশাসই চেহারার অধিকারী হলেও, হিংস্রতার বিন্দুমাত্র আভাস ছিল না তাঁর চরিত্রে। বরং, তার আচরণ ছিল অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। সেনাদের কোলে-পিঠে ‘মানুষ’ হওয়ায় দিব্যি দু’পায়ে হাঁটতে শিখে গিয়েছিল ওজটেক। অভ্যস্ত ছিল মদ্যপান কিংবা ধূমপানেও। সেনাদের সঙ্গে মানুষের কায়দায় কুস্তিও লড়ত ইরানিয় ব্রাউন বিয়ারটি। এমনকি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে তার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল দ্বিগুণ পরিমাণ রেশন।
আরও পড়ুন
তৃষ্ণার্ত সেনানীরা, বিশ্বযুদ্ধে বিয়ার ফেরির দায়িত্বে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান!
এক কথায় পরিবারহীন ছেড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়তে আসা সেনাদের কাছে বিনোদনের একমাত্র পথ হয়ে উঠেছিল ওজটেক। তবে মাঝেমধ্যেই তার জন্য এক অদ্ভুত সমস্যায় পড়তে হত পোলিশ সেনাদের। যুদ্ধক্ষেত্রে একেই জলের অভাব, তার ওপর যেটুকু জল বরাদ্দ হত তা হামেশাই নষ্ট করত ওজটেক। কল চালানোর কায়দা শিখে নিজেই ঢুকে পড়ত স্নানঘরে। তারপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলত জলকেলি। কিন্তু ওজটেকের এই ‘উৎপাত’-ই শেষ অবধি শাপে বর হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের কাছে। স্নানঘরে আকস্মিক ঢুকে পড়েই সে ধরিয়ে দিয়েছিল ইতালির গুপ্তচরকে।
সেই ঘটনার পরই ১৯৪৩ সালে ইউনিট সদস্যের সম্মান দেওয়া হয় ওজটেককে। তারপর থেকে নিয়মিতই যুদ্ধের ময়দানে হাজিরা দিত প্রকাণ্ড ভালুকটি। কাজ ছিল সেনাশিবির থেকে কার্তুজ আর কামানের গোলা-বোঝাই বাক্স যুদ্ধের ময়দানে স্থানান্তরিত করা। আর মানব সৈনিকের থেকে বহুগুণ দ্রুততায় সেই কাজ করত পোষ্য ভালুকটি।
তবে বিশ্বযুদ্ধের পরেই অস্তিত্বের সংকটে পড়ে ওজটেক। এত বড়ো ভালুকের দায়ভার তো আর একার পক্ষে টানা সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই পিছু হঠেছিলেন ওয়াসেজিচ। অন্যদিকে ওজটেককে গ্রহণ করতে চায়নি পোল্যান্ডের সরকারও। শেষ পর্যন্ত তাঁর ঠাঁই হয় স্কটল্যান্ডের এক চিড়িয়াখানায়। সেই শেষবারের জন্য ওয়াসেজিচ দেখেছিলেন ওজটেককে। পোল্যান্ডের স্বাধীনতার পরই সেখানে জারি হয়ে যায় বিদেশভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা। ফলত, ইচ্ছে থাকলেও আর প্রিয় পোষ্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতে পারেননি তিনি। ষাটের দশকের শেষের দিকেই চিড়িয়াখানায় মৃত্যু হয় ওজটেকের। বিশ্বের প্রথম সারির সমস্ত পত্রিকাতেই জায়গা করে নিয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের এই নির্বাক নায়কের মৃত্যুসংবাদ।
অবশ্য ওজটেকের মৃত্যুর বহুবছর পর তার কৃতিত্বকে স্বীকৃতি দেয় পোল্যান্ড সরকার। সেনা বিভাগে চালু করা হয় তার নামাঙ্কিত বিশেষ মেডেল। সেই মেডেলে দৃশ্যমান কার্তুজ বহনকারী ওজটেকের ছবি। ২০১১ সালে ওজটেককে নিয়ে বিশেষ তথ্যচিত্র তৈরি করেন হার্ভি। প্রযোজনা করেছিল খোদ পোল্যান্ড সরকার। অবশ্য তারও তিন দশক আগে ’৮২ সালে প্রথমবার বড়ো পর্দায় দেখা গিয়েছিল ওজটেককে। ‘দ্য স্নোম্যান’ অ্যানিমেশন সিনেমায়। অন্যদিকে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ চিড়িয়াখানায় ২০১৫ সালে ওজটেকের ব্রোঞ্জমূর্তি স্থাপন করে যুক্তরাজ্য। বসানো হয় বিশেষ স্মৃতিফলকও। প্রায় সাড়ে সাত দশক হল বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীদের সংখ্যাও হাতে গোনাই। কিন্তু এত এত বছর পর আজও ইউরোপে এতটুকু কমেনি ওজটেকের জনপ্রিয়তা…
Powered by Froala Editor