দিব্যি ছিমছাম সাজানো গোছানো একটি গ্রাম। পাহাড়ের ঢালে সারি সারি বাড়ি। স্কুল, হাসপাতাল সবই আছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করেন সেখানকার মানুষ। শুধু মোটরগাড়ি চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। না, তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের হতদরিদ্র গ্রামের দৃশ্য নয়। খোদ ইতালির বুকে রয়েছে এই গ্রাম। ইতালির দ্বিতীয় উচ্চতম গ্রাম স্যাময়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তার উচ্চতা ১৮১৮ মিটার। তবে এই একটি গ্রামেই এখনও অবধি যাতায়াতের জন্য কোনো রাস্তা নেই। এমনকি গ্রামবাসীরাও চান না সড়কপথ তৈরি হোক।
অষ্টাদশ শতকে একটিমাত্র পরিবার এসে থাকতে শুরু করে এই গ্রামে। তারপর ধীরে ধীরে বেড়েছে বসতি। এক সময় ৩৫০ জনের বেশি মানুষ বাস করত। তবে এখন সংখ্যাটা আবার ১৫০-এর আশেপাশে নেমে এসেছে। আসলে এমন বিচ্ছিন্ন একটা গ্রামে থাকতে চান না অনেকেই। কিন্তু যাঁরা আছেন তাঁরা ভালোবেসেই আছেন। এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে অর্থনৈতিক কারণে এই গ্রামে সড়কপথ তৈরি করা যায়নি। বরং ইতালি সরকার বারবার সেই চেষ্টা করেছে। কিন্তু গ্রামবাসীদের অনুমতি পাওয়া যায়নি। ১৯৫৫ সালে প্রথমবার সরকারের কাছ থেকে প্রস্তাব আসার পর একটি গণভোটের আয়োজন করা হয় স্যাময় গ্রামে। তবে প্রত্যেকে একবাক্যে সড়কপথের বিরোধিতা করেছিলেন। তার বদলে অবশ্য ৯৫ শতাংশ মানুষের সম্মতি নিয়ে তৈরি হয়েছিল নতুন একটি প্রকল্প। সেটি হল, কেবলওয়ে বা রোপওয়ে পরিবহন। দড়িতে ঝোলানো চেয়ারে বসেই গ্রাম থেকে বাইরের জগতে এবং বাইরের জগৎ থেকে স্যাময় গ্রামে যাতায়াত করেন মানুষ।
কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত এখানকার মানুষের? এর উত্তর পেতে গেলে ফিরে যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের ইতালিতে। মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনে যখন নাভিঃশ্বাস উঠেছে সেখানকার মানুষের। পাশাপাশি পার্টিজান কমিউনিস্টদের সশস্ত্র আন্দোলনও চলছে। রোজ প্রতিটা শহর ও গ্রামের রাস্তায় পড়ে থাকছে মানুষের লাশ। অথচ এসবের মধ্যেও দিব্যি শান্তিতে ছিলেন স্যাময়ের বাসিন্দারা। যাতায়াতের কোনো রাস্তা না থাকার কারণেই ফ্যাসিস্ট বা পার্টিজান কেউই এখানে পৌঁছতে পারেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মিটে গেলেও তাই গ্রামবাসীরা আর চাননি বাকি ইতালির সঙ্গে যোগাযোগ দৃঢ় করতে। তবে এর জন্য নিজেদের বিচ্ছিন্ন বা অসামাজিক বলে মনে করেন না সেখানকার মানুষ। বরং তাঁদের কথায়, পৃথিবীর বাকি সমস্ত জায়গা থেকে মানুষের যৌথতার সংস্কৃতিকে মুছে ফেলছে যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি। স্যাময়ের মানুষ কিন্তু এখনও সকলে মিলে একসঙ্গে বাঁচতে জানেন। এই গ্রাম এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাছাড়া সড়কপথ না থাকায় নেই দূষণের প্রভাবও। ইতালি সরকার বিদ্যুতের লাইন পোঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল কয়েক বছর আগে। কিন্তু গ্রামবাসীরা সেই প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছেন একটি জলবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট। একুশ শতকে দাঁড়িয়েও যেন আন্তর্জাতিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এখানকার মানুষ। আর এই যুদ্ধ সারা বিশ্বকে একটা স্বনির্ভর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে পারে।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দেশভাগে হারিয়ে ফেলা গ্রামকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ভিআর প্রযুক্তি