খোলা-বন্ধ হয় চোখের পাতা, ইতালির এই জীবন্ত মমির রহস্য কী?

দক্ষিণ ইতালির সিসিলি প্রদেশের পালেরমো শহর। এই শহরেই রয়েছে আস্ত একটি ক্যাটাকম্ব, অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ সমাধিক্ষেত্র। সেখানে থরে থরে সাজানো মমি। শুধু তাই নয়, এই গুহাতেই বাস এক জীবন্ত মমিরও (Living Mummy)।

না, কোনো আজগুবি গল্প কিংবা সাইফাই সিনেমার প্রেক্ষাপট নয়। আক্ষরিক অর্থেই এই মমি জীবন্ত। সে মিটি মিটি চেয়ে থাকে দর্শকদের থেকে। কখনও চোখ বন্ধ করে ঘুমোয়, আবার কখনও চোখ খুলে দেখে নেয় কারা দেখতে এসেছেন তাকে। তবে কি কোনো অলৌকিক ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে এই মমির সঙ্গে? মমিকৃত এই ছোট্ট শিশুটির পরিচয়ই বা কী? 

মমি বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিশরের মরুপ্রদেশের ছবি কিংবা মেক্সিকো। তবে এই আফ্রিকা কিংবা ল্যাটিন আমেরিকা ছাড়াও মমির প্রথা ছিল ইউরোপেও। ছিল কেন? এখনও রয়েছে। মধ্যযুগ থেকেই মৃতদেহ মমি করে রাখার চল বাড়ে ইতালিতে (Italy)। এমনকি এখনও ইতালির বুকে একটি শহর আছে, যেখানে মমিদের সঙ্গেই বসবাস করেন তাদের উত্তরসূরিরা। 

সে যাই হোক, আমরা যে মমিটিকে নিয়ে কথা বলছি, সেটি তৈরি হয়েছিল ১৯২০ সালে। ব্রঙ্কোপনিউমোনিয়া— এই মারণ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় রোজালিয়া লম্বার্ডো (Rosalia Lombardo) নামের এক শিশু। তখনও ২ বছর পূর্ণ হতে এক সপ্তাহ বাকি তার। রোজালিয়ার বাবা মারিও আগেই স্প্যানিশ ফ্লু-তে হারিয়েছিলেন তাঁর পুত্রকে। তার বছর তিনেকের মধ্যেই শিশুকন্যাকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন রীতিমতো। নাই থাকুক হৃদস্পন্দন, তা-সত্তেও যেন-তেন-প্রকারে বাঁচিয়ে রাখবেন তার দেহ— এমনটাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন মারিও। সিদ্ধান্ত নেন মমি করে রাখাবেন তাঁর কন্যাকে। তবে যে-সে তো আর মমি বানাতে পারেন না। সে-সময় মমি বিশেষজ্ঞদের নাগাল পেতে ছুটতে হয় কেবলমাত্র সিসিলিতেই। 

আরও পড়ুন
খোলা-বন্ধ হয় চোখের পাতা, ইতালির এই জীবন্ত মমির রহস্য কী?

হয়েছিলও তেমনটা। বিশেষ তলব পড়েছিল সিসিলি তথা ইতালির সুপরিচিত ফার্মাসিস্ট ও দেহ-সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞ অ্যালফ্রেডো সালাফিয়ার। মোটা অঙ্কের টাকার পারিশ্রমিক দিয়েই তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল সিসিলি থেকে। তবে পুরো ঘটনার ব্যাপারে জানতে পেরে, এক টাকাও পারিশ্রমিক নেননি সালফিয়ার। বদলে যেন জাদুবলেই জীবন্ত করে তুলেছিলেন রোজালিয়ার মৃতদেহ। তাঁর মমিকরনের কৌশলেই যেন প্রাণ ফিরে আসে রোজালিয়ার চোখে। তার চোখের পাতা কখনো খুলছে, কখনও বন্ধ হচ্ছে। এমন বিস্ময়কর ঘটনায় অবাক হয়েছিলেন স্বয়ং মারিও-ও। তাঁর ডায়েরিতেও উল্লেখ পাওয়া যায় এই ঘটনার। কিন্তু কীভাবে মৃতদেহ জীবিত করে তুলেছিলেন ফার্মাসিস্ট সালাফিয়ার?

আরও পড়ুন
জ্যান্ত মানুষের সঙ্গেই বসবাস করে ইতালির মমিরা!

প্রায় আরও ৯০ বছর পর সমাধান মেলে সেই রহস্যের। নেপথ্যে ইতালির জৈবিক নৃবিজ্ঞানী দারিও পিওম্বিনো মাস্কালি। মাস্কালি আবিষ্কার করেন, আদতে চোখের পাতা খোলা বা বন্ধ হচ্ছে না রোজালিয়ার। মমিকরনের সময় ইচ্ছাকৃতভাবেই সালাফিয়ার আধবোজা করে রেখেছিলেন রোজালিয়ার চোখের পাতা। তার ওপরে প্রলেপ দিয়েছিলেন ইথারে দ্রবীভূত প্যারাফিন এবং রেজিনের। যা কাজ করে অনেকটা লেন্সের মতোই। তাই বিভিন্ন কোণ থেকে কখনও চোখ খোলা মনে হয়, কখনও আবার বন্ধ। আদতে তা একটি অপটিক্যাল ইলিউশন। 

আরও পড়ুন
মিশর নয়, পৃথিবীর প্রাচীনতম মমিদের বাসস্থান চিলি

২০০৯ সালে এই রহস্যের যবনিকা পতন হলেও, রোজালিয়ার মমি আজও পরিচিত ‘ক্যাপুচিন ক্যাটাকম্বের জীবন্ত মমি’ নামেই। কারোর কাছে আবার তার পরিচয় ‘সিল্পিং বিউটি অফ ক্যাপুচিন ক্যাটাকম্ব’। তবে আর কতদিন টিকে থাকবে এই মমি তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ক্যাটাকম্বের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতায় বদল আসায়, পচন শুরু হয়েছে রোজালিয়ার দেহে। বছর খানেক আগে তার মমিকে ক্যাটাকম্বের তুলনামূলক শুষ্ক জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যায় ইতালির প্রশাসন। কাচের পাত্রে নাইট্রোজেন গ্যাস ভরে বন্ধ রাখা হয় তাকে। তবে তাতেও যে রোজালিয়ার আয়ু খুব বেশি বৃদ্ধি পাবে, এমনটা নয়। আর হয়তো কয়েক দশকের মধ্যেই চিরতরে হারিয়ে যাবে বিশ্বের একমাত্র জীবন্ত মমি…

Powered by Froala Editor