পৃথিবীর একমাত্র ‘সমকামীদের জেলখানা’

অস্ট্রেলিয়ার স্নো-মাউন্টেইন হাইওয়ের ধারে ছোট্ট শহর কুমা। শহরের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন এক জেলখানা। নিউ সাউথ ওয়েলস অঞ্চলে উপনিবেশ তৈরির সময় এখানেই উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের বন্দি করে রাখতেন ইউরোপীয়রা। এক সময় সেই জেলখানা বন্ধও হয়ে যায়। তবে ১৯৫৭ সালে আবার নতুন করে খোলা হয় কুমা জেলের (Cooma Jail) দরজা। কিন্তু কেন আবার জেলখানাটি খোলার প্রয়োজন হল? সম্প্রতি আমাজন পডকাস্টের উদ্যোগে সামনে এল সেই ইতিহাস। সম্ভবত এটিই ছিল পৃথিবীর একমাত্র জেলখানা, যেখানে বন্দি হিসাবে রাখা হত শুধুমাত্র সমকামী পুরুষদের (Gay)।

একদিকে পাহাড়ি পরিবেশে প্রবল ঠান্ডায় শরীর জমে আসে। আবার তার সঙ্গেই সারাবছর ঝোড়ো হাওয়ার দাপট। অবস্থানগত কারণেই কুমা জেলখানা হয়ে উঠেছিল এক মূর্তিমান বিভীষিকা। তবে এখানেই শেষ নয়। কুমা জেলখানার বন্দিদের সবচেয়ে বড়ো আতঙ্কের কারণ ছিল, এখানে একজন বন্দি অন্য কোনো বন্দির মুখ দেখতেও পেত না। কারণ জেলের প্রতিটি কুঠুরিই ছিল একজন বন্দির থাকার জন্য। কিন্তু কেন এই ব্যবস্থা? গত ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে প্রকাশিত পডকাস্টটিতে সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সমসাময়িক পুলিশ কর্মীরা।

পুলিশের কথায়, কুমা জেলখানা থেকে বন্দিরা যাতে পালাতে না পারে, সেদিকে সবসময়ই বাড়তি নজর দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য তা বন্দিদের নিরাপত্তার জন্যই দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করছেন পুলিশ অফিসাররা। কারণ সেই সময়ের আইন অনুযায়ী সমকামিতার অভিযোগে কেউ ধরা পড়লে তাঁর শরীরে উল্কি এঁকে চিহ্ন করে দেওয়া হত। ফলে বাইরের জগতে তাঁদের পক্ষে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তবুও বন্দিরা সবসময়ই জেল ভেঙে পালানোর চক্রান্ত করতেন। অবশ্য পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে নানারকম। কখনও কখনও দুজন পুরুষকে ঘনিষ্ঠভাবে গল্প করতে দেখেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অথবা গ্রেপ্তার করার পর প্রকাশ্যে দুজন পুরুষকে যৌন সঙ্গমে বাধ্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছেন অনেকে।

তবে কুমা জেলখানা যে শুধুই বন্দিনিবাস ছিল, তা কিন্তু নয়। বরং এখানে সরকারি উদ্যোগে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। এই কাজে যুক্ত ছিলেন ডাক্তার, মনোবিদ থেকে শুরু করে ধর্মযাজক এবং সমাজবিজ্ঞানীরাও। নানারকম তত্ত্বও তৈরি করেছিলেন তাঁরা। যেমন একটি তত্ত্ব অনুসারে ছোটোবেলায় মায়ের কোনো আচরণে বিরক্ত হয়েই পুরুষরা ক্রমশ মহিলাদের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েন। বস্তুতঃ সমকামিতা যে একটি অসুখ, এই বিষয়ে প্রত্যেকেই একমত ছিলেন।

ঠিক কতদিন কুমা জেলখানার এই ব্যবস্থা টিকে ছিল, তা অবশ্য পডকাস্টটি থেকে জানা যায় না। তবে নিউ সাউথ ওয়েলস কারা বিভাগের নথি থেকে জানা যায়, ১৯৮২ সালেও সেখানে গবেষণার জন্য নতুন দল নিয়োগ করা হচ্ছে। এর ঠিক ২ বছরের মাথায়, ১৯৮৪ সালে নিউ সাউথ ওয়েলস আদালত জানায় সমকামিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়। এমনকি এটা কোনো অসুখও নয়। বরং মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ফলে কুমার জেলখানাও আবার বন্ধ হয়ে যায়। তবে এর অন্ধকার ইতিহাসকে কি আদৌ মুছে ফেলা সম্ভব হবে কোনোদিন?

Powered by Froala Editor