আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগের কথা। ১৯২২ সাল। বর্তমান ইরাকের সুমেরের ‘আর’ শহরে বেশ কিছু প্রাচীন মন্দিরের সন্ধান পান ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক লিওনার্ড উলি। তবে মন্দিরের স্থাপত্যের চেয়েও বেশি অবাক করেছিল সেখানকার দেওয়ালে লেখা বেশ কিছু শিলালিপি। মজার বিষয় হল, প্রতিটি শিলালিপির শেষেই পুনরাবৃত্ত হয়েছিল একটি বিশেষ অক্ষরমালা। কী অর্থ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছিল এই বিশেষ শব্দটি?
এই উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হয় আরও ৫ বছর। ১৯২৭ সালে সুমেরীয় লিপির পাঠোদ্ধারের পর জানা যায়, সেখানে লেখা রয়েছে ‘এনহেদুয়ান্না’ (Enheduanna)। না, কোনো অর্থবহ কথা নয়, এনহেদুয়ান্না আদতে একটি ব্যক্তির নাম। মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা শিলালিপির নেপথ্যে রয়েছেন তিনিই। কিন্তু কে এই এনহেদুয়ান্না?
গবেষকদের মতে, তিনিই বিশ্বের প্রাচীনতম ‘পরিচিত’ লেখক (Oldest Known Author)। অর্থাৎ, শিল্পসৃষ্টির পর নিজের লেখার নিচে স্বাক্ষর করার প্রচলন শুরু করেছিলেন তিনিই। তাও আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে। ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তবে আরও একটি পরিচয় রয়েছে তাঁর। তিনি সুমেরীয় সম্রাট প্রথম সারগনের জ্যেষ্ঠ কন্যা। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। যেখানে আজকের সমাজ লিঙ্গবৈষম্যের শিকার, সেখানে দাঁড়িয়ে আজ থেকে চার হাজার বছর আগেই এক মহিলাই সাহিত্যের আলো জ্বেলেছিলেন প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায়।
শুধু কবিতা রচনা বা সাহিত্যসৃষ্টিই নয়, একইসঙ্গে গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যাতেও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন সুমেরীয় রাজকুমারী। এমনটাই স্পষ্ট ফুটে ওঠে প্রাচীন নথিতে। পাশাপাশি প্রাচীন আক্কাদ দেশের প্রধান পুরোহিত ছিলেন এনহেদুয়ান্না। আশ্চর্যের বিষয় হল, রাজকন্যা হওয়ার জন্য অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাব থাকার জন্যই যে তিনি প্রধান পুরোহিতের মর্যাদা পেয়েছিলেন, বিষয়টা এমন নয় একেবারেই। প্রধান পুরোহিতের পদে অভিষেকের আগে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছিলেন তিনি। রচনা করেছিলেন চন্দ্রদেবী নান্না এবং যুদ্ধের দেবী ইয়ান্নার একগুচ্ছ মন্ত্র। সেই মন্ত্রই পরবর্তীতে জায়গা করে নেয় প্রাচীন সুমেরের মন্দিরে মন্দিরে।
কবিতা এবং মন্ত্র নিয়ে এখনও পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৪২টি শিলালিপি পাওয়া গেছে এনহেদুয়ান্নার। যা রীতিমতো মুগ্ধ করতে পারতে আজকের মানুষকেও। সে-সময়কার সমাজেও যে তাঁর প্রভাব ছিল যথেষ্ট, তার পরিচয় পাওয়া যায় পাথরে খোদাই করা তাঁর মূর্তি ও পরিচয়-বৃত্তান্ত থেকে। অন্যদিকে তৎকালীন সমাজে নারীদের সমানাধিকার, সাম্য এবং যাপনচিত্রের পরিচয়ও পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। তবে দুঃখের বিষয় হল, এনদেদুয়ান্নার মন্ত্র বা কবিতাগুলি লেখা হয়েছিল তৎকালীন মন্দিরের দেওয়ালে, তাই প্রাচীনতম লেখক হিসাবে পরিচিত হলেও, প্রাচীনতম গ্রন্থের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত থেকে যান মেসোপটেমিয়ার রাজকুমারী…
Powered by Froala Editor