কখনও উটের পিঠে, কখনও যুদ্ধযানে— পৃথিবীর আশ্চর্য কিছু ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গল্প

/৯

তাকের ওপর সাজানো সারি সারি বই। মাঝে চেয়ার-টেবিল পাতা। পিন পড়া নীরবতা গোটা হলে। লাইব্রেরি বলতে এমন ছবিই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তবে ক্রমেই বদলাচ্ছে পরিস্থিতি। ব্যস্ততা বাড়ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। ফলে বদলাচ্ছে লাইব্রেরির পাঠকের সংখ্যা। তাই পথ-চলতি মানুষের কাছে বই পড়ার আমেজ পৌঁছে দিতে বর্তমানে জনপ্রিয়তা পেয়েছে স্ট্রিট লাইব্রেরি। পাশাপাশি চল বেড়েছে ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগারও। তবে এর পিছনেও রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক পৃথিবীর এমনই কিছু আশ্চর্য মোবাইল লাইব্রেরির দৃষ্টান্ত।

/৯

ওয়াকিং লাইব্রেরি— পিঠে ব্যাগ ঝোলানো কাঠের ছোট্ট তাক। তার মধ্যে সাজানো রয়েছে গুটি কয়েক বই। সাদাকালো এই ছবির সঙ্গে পরিচিত অনেকেই। ছবিটি লন্ডনের বুকে তোলা হয় ১৯৩০ সালে। সম্ভবত এটিই মোবাইল লাইব্রেরির প্রাচীনতম নিদর্শন। লন্ডন ছাড়াও এই লাইব্রেরির দেখা মেলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেই। এহেন লাইব্রেরি রয়েছে কলকাতাতেও। পায়ে হেঁটে মোবাইল লাইব্রেরিয়ানরা পৌঁছে যান পাঠকদের কাছে।

/৯

হাউস ভ্যান মোবাইল লাইব্রেরি— ছোট্ট টেম্পোর পিঠেই বাড়ির আকারে তৈরি একটি ঘর। আদতে যা বইয়ের ভাণ্ডার। বিগত ১৬ বছর ধরে ইতালিজুড়ে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে এই অভিনব লাইব্রেরি। নেপথ্যে, ইতালির অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক অ্যান্টোনিও লা কাভা। অবসরের পর, সাধারণ মানুষকে বইমুখো করতে এমন উদ্যোগ নেন তিনি। ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই নিয়েই গড়ে তোলেন মোবাইল লাইব্রেরিটি। এখনও পর্যন্ত এই লাইব্রেরিকে সঙ্গী করে ১ লক্ষ কিলোমিটারেরও বেশি পথ অতিক্রম করেছেন অ্যান্টোনিও।

/৯

বিবলিওবুরো— কলোম্বিয়ার স্থানীয় ভাষায় প্রচলিত এই কথাটির বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘গাধা গ্রন্থাগার’। হ্যাঁ, নামটা একটু অদ্ভুতই। তবে কলোম্বিয়ার প্রান্তিক গ্রাম লা গ্লোরিয়ায় গাধার পিঠে চড়েই লাইব্রেরির পরিষেবা প্রদান করেন লুইস সোরিয়ানো। অ্যান্টোনিও-র মতো তিনিও একজন শিক্ষক। তবে লুইসের এই উদ্যোগ খানিক ভিন্ন। মূলত, দরিদ্র শিশুদেরকেই লাইব্রেরি পরিষেবা প্রদান করেন তিনি। ১৯৯০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁর এই কর্মকাণ্ডে উপকৃত হয়েছে ৫ হাজার কলোম্বিয়ান কিশোর-কিশোরী।

/৯

ক্যামেল লাইব্রেরি— লুইসের বিবলিওবুরোর সঙ্গে হুবহু মিলে যায় কেনিয়ার এই গ্রন্থাগারের ছবি। শুধু গাধার পরিবর্তে এখানে পরিষেবা প্রদানের মাধ্যম উট। তবে কোনো একক ব্যক্তির উদ্যোগ নয়, এই গ্রন্থাগার পরিচালনা করে কেনিয়া সরকারের জাতীয় গ্রন্থাগার পরিষদ। উত্তর-পূর্ব কেনিয়ার দুর্গম অঞ্চলগুলিতে উটের মাধ্যমে পৌঁছে যায় বই। সব মিলিয়ে ৯টি উট এবং ৩টি ক্যারাভ্যান নিয়ে চলছে এই লাইব্রেরি। গ্রাহকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। প্রায় চার হাজার মানুষ এই লাইব্রেরির সদস্য।

/৯

ফ্লোটিং লাইব্রেরি— চলতি বছরের শুরুতেই কলকাতায় চালু হয়েছিল ভারতের প্রথম ভাসমান গ্রন্থাগার। হুগলি নদীতে লঞ্চের ওপরে গড়ে উঠেছিল আস্ত লাইব্রেরি। তবে এরও প্রায় ছ’দশক আগে বিশ্বের প্রথম ভাসমান গ্রন্থাগারের জন্ম হয়েছিল নরওয়েতে। ১৯৫৯ সালে। শীত পড়লেই তুষারপাতের কারণে নরওয়ের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ফিওয়র্ডস দ্বীপ। ফলে গ্রন্থাগারের পরিষেবা থেকেও বঞ্চিত হতেন সেখানকার মানুষ। সেই সমস্যার সমাধান হিসাবেই এই ‘লাইব্রেরি বোট’ তৈরি করে নরওয়ে প্রশাসন। শুধু বই-ই নয়, অডিও বুকেরও বিপুল সম্ভার রয়েছে এই লাইব্রেরিতে। হাতে সময় থাকলে, ভাসমান এই লাইব্রেরি বসেই শোনা যায় গ্রন্থপাঠের রেকর্ড।

/৯

আর্মা ডে ইনস্ট্রাসিয়ন ম্যাসিভা— স্প্যানিশ কথাটির আক্ষরিক অর্থ ‘ওয়েপন অফ মাস ইনস্ট্রাকশন’। ‘ওয়েপন’ অর্থাৎ অস্ত্র শব্দটিতেই ধাক্কা লাগছে নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, লাগারই কথা। কারণ, এই লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে যুদ্ধযানের ওপরেই। আদতে এই সামরিক ট্যাঙ্ক ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে আর্জেন্টাইন রেভোলিউশনের সময়। গৃহযুদ্ধের শেষে ‘ওয়েপন অফ মাস ডেস্ট্রাকশন’ অর্থাৎ ধ্বংসের অস্ত্রই হয়ে ওঠে উন্নয়নের চাবিকাঠি। যুদ্ধাস্ত্র ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ খুলে ফেলে সেখানে জায়গা করে দেওয়া হয় গ্রন্থের। প্রায় আড়াই হাজার বই নিয়ে আজ আর্জেন্টিনার রাস্তায় শান্তির বার্তা দেয় এই লাইব্রেরি।

/৯

১৯৪৯-শেভি লাইব্রেরি— এই লাইব্রেরির নেপথ্যে রয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার বাসিন্দা মিস্টার হ্যান্ডারসন। তবে লাইব্রেরি নির্মাণ তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। এক যুগ আগের কথা। ভ্রমণপিপাসু হ্যান্ডারসন নিজের শখের শেভ্রোলেট-১৯৪৯ গাড়িতে দেশভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সঙ্গী ছিল একরাশ বই। তবে দেশভ্রমণে বেরিয়ে বদলে যায় তাঁর নেশা। তাঁর বইয়ের সম্ভার দেখে আকৃষ্ট হতেন পথচলতি মানুষরা। তারপরই নিজের গাড়িকে লাইব্রেরিতে বদলে ফেলেন তিনি। ৯১ বছর বয়স পর্যন্ত এই গাড়িতে করেই ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির পরিষেবা প্রদান করেছেন মার্কিন বৃদ্ধ।

/৯

মোবাইল লাইব্রেরি ট্রেন— দেশের সীমানা, কাঁটাতার, ভাষা কিংবা সংস্কৃতি— সমস্ত বিভেদরেখা লঙ্ঘন করেছে আফ্রিকার এই অভিনব লাইব্রেরি। না, কোনো বিশেষ দেশের ‘সম্পত্তি’ নয় এই লাইব্রেরি। বরং, গোটা আফ্রিকাজুড়ে অবাধ বিরাজ ‘ওপেনেশন লেকচার পাবলিক’-খ্যাত এই লাইব্রেরির। দুর্গম মরু অঞ্চলে কয়েকদিনের জন্য থামে এই দু’বগির ছোট্ট রেলগাড়ি। তারপর আবার যাত্রা শুরু হয় অন্য জায়গার উদ্দেশে। শুধু আফ্রিকা নয়, এই একইরকম লাইব্রেরি পরিষেবা রয়েছে জার্মানিতেও।

Powered by Froala Editor