মৃত্যু বনাম ভাগ্যের দ্বৈরথ, কীভাবে জন্ম হয়েছিল রাশিয়ান রুলেটের?

অটোমান সম্রাটের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে রাশিয়ার জারের। কীটপতঙ্গের মতো মানুষ মারা যাচ্ছে কাতারে কাতারে। সেনা তো বটেই, জীবনের নিশ্চয়তা নেই সাধারণ মানুষদেরও। এমনই একটা সকাল ছিল সেটা। সকালের আলো ফোটার পর সেনাছাউনিতে হাজির হয়েছেন জারের সেনারা। চলছে যুদ্ধক্ষেত্রে নামার প্রস্তুতি, সামান্য দু’দানা খাবার মুখে দেওয়ার পর্ব। সহযোদ্ধাদের মধ্যে ঈষৎ গল্পগুজবও। সেদিন এমনই দুই রাশিয়ান যোদ্ধার মধ্যে কথা চলছিল জীবনের নিশ্চয়তা নিয়ে। যুদ্ধ থেকে কি আদৌ জীবিত ফিরতে পারবেন তাঁরা? এই তর্ক-বিতর্কের মাঝেই উঠে আসে ভাগ্য পরীক্ষার প্রস্তাব। সঙ্গে সঙ্গেই হাতে বন্দুক তুলে নেন এক রাশিয়ান সেনা। সিলিন্ডার ঘুরিয়ে তিনি কপালে ঠেকালেন সেই পিস্তল। তারপরই ট্রিগারে চাপ। খুচ করে একটা আওয়াজ হল বটে, তবে গুলি বেরল না। এবার সেই একই বন্দুক দেওয়ালে ঝোলানো একটি টুপির দিকে তাক করে ট্রিগার চাপতেই কানফাটা শব্দে কেঁপে উঠল ছাউনি। না, সম্পূর্ণ খালি ছিল না বন্দুক!

এই অদ্ভুত ভাগ্যপরীক্ষা পরিচিত ঠেকছে নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, কথা হচ্ছে তামাম বন্দুকবাজির খেলা রাশিয়ান রুলেট (Russian Roulette) নিয়েই। আর উপরে বর্ণিত দৃশ্যটি? ১৮৪০ সালে প্রকাশিত রাশিয়ান কথাশিল্পী মিখাইল লারমনটোভের ক্লাসিক উপন্যাস ‘দ্য হিরো অফ আওয়ার টাইম’-এর অংশ। এই দৃশ্য আদৌ সত্যি নাকি কাল্পনিক— তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই কোনো। তবে এই বর্ণনাই রাশিয়ান রুলেটের সর্বপ্রথম লিখিত নথি হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। যদিও এই অদ্ভুত খেলার জন্ম নিয়ে বিতর্কও রয়েছে প্রবল। 

সেই যাই হোক না কেন, ‘রাশিয়ান রুলেট’ কথাটির জন্ম অবশ্য এরও প্রায় এক শতাব্দী পরে। ১৯৩৭ সালে কোলিয়ার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আমেরিকান লেখক জর্জস আর্থার সুরডেজের একটি গল্পে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় কথাটির। গল্পটির শিরোনামও ছিল ‘রাশিয়ান রুলেট’। অবশ্য ঐতিহাসিক গল্প হিসাবে এই গল্পটিকে চিহ্নিত করা হলেও, তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই। সুরডেজের গল্পে যে বন্দুক ব্যবহৃত হয়েছিল রাশিয়ান রুলেটে, সেটি একটি ছয় গুলির রিভলভার। অথচ, সেইসময় রাশিয়ায় ব্যবহৃত হত সাতটি গুলিবিশিষ্ট ন্যাগেট এম১৮৯৫ পিস্তল। 

তবে এই গল্পের সত্যতা যাই হোক না কেন, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ান রুলেটের জনপ্রিয়তা আগুন মতোই ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা রাশিয়ায়। একটা সময় যেমন ইতালি, ফ্রান্স কিংবা ব্রিটেনে আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ডুয়েল লড়াই, রাশিয়ায় ঠিক তেমনই ছিল রাশিয়ান রুলেটের খেলা। ধীরে ধীরে তার চল বাড়ে ইউরোপের দেশগুলিতেও। 

আরও পড়ুন
আমেরিকাকে মাত্র ৭২ লক্ষ ডলারে আলাস্কা বিক্রয়, রাশিয়ার ঐতিহাসিক ‘ভুল’

নিছক খেলা কিংবা আত্মসম্মানের লড়াইয়ের বাইরেও নৃশংসতার অন্য মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল রাশিয়ান রুলেট। বিশেষ করে দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়। কারাগারে বন্দি বিপক্ষের সৈনিকদের এই খেলা খেলতে বাধ্য করতেন রাশিয়ান অফিসাররা। যা নিতান্তই বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল রাশিয়ায়। 

আরও পড়ুন
বিশ্বের বৃহত্তম দেশ, প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশও; কেন ‘অজেয়’ রাশিয়া?

তবে যুগের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ রূপ বদলেছে এই খেলার। বর্তমানে রাশিয়া, কোরিয়া-সহ একাধিক দেশে বেশ ঘটা করেই খেলা হয় রাশিয়ান রুলেট। টাকা দিয়ে পার্লারে গিয়ে খেলতে হয় রাশিয়ান রুলেট। আসল বন্দুকের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় ইলেকট্রনিক গান এবং রবার বুলেট। অবশ্য আসল বন্দুকের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও, একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি তা। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর এখনও প্রায় চল্লিশের বেশি মানুষের মৃত্যু হয় রাশিয়ান রুলেটে। এমনকি ভারতেও বছর চারেক আগে রাশিয়ান রুলেট খেলতে গিয়ে প্রয়াত হয়েছিলেন এক কলেজপড়ুয়া তরুণী। 

আরও পড়ুন
নোবেলজয়ের দিনেই দেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগ রাশিয়ার

বিশ্বের অন্যতম ‘আগ্রাসী’ এবং ‘যুদ্ধবাজ’ জাতি হিসাবেই পরিচিত রাশিয়ানরা। তাঁদের প্রবর্তিত এই ঘাতক খেলাতেও যেন মিশে রয়েছে সেই আগ্রাসনেরই ইঙ্গিত… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More