আগুনে পুড়েও অক্ষত বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থাগারের সমস্ত ‘বই’!

বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে রাজ্য আক্রমণ করতে আসছেন পার্শ্ববর্তী রাজ্যের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সম্রাট। জেতার কোনো সম্ভাবনাই নেই। হয় প্রাণ দিতে হবে যুদ্ধে, নয় বশ্যতা স্বীকার করে তাঁর হাতে তুলে দিতে হবে উপঢৌকন। যে-কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই বলবেন, এই দুই বিকল্পের মধ্যে দ্বিতীয়টিই শ্রেয়। কিন্তু কী উপহারে সন্তুষ্ট হবেন সম্রাট? 

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া একটু কঠিন। যেমন বিভিন্ন দেবতা সন্তুষ্ট হন এক এক ফুলে, তেমনই সম্রাট বিশেষে বদলে যায় তাঁদের পছন্দও। কেউ খুশি হন মণিমাণিক্যে, কেউ আবার সোনাদানায়। তবে এসব ছেড়ে সম্রাটের যদি হুকুম দেন রাজ্যের সমস্ত গ্রন্থ তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য? 

অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন বই। রাজ্য দখলের পর এমনই ‘বেয়াড়া’ আবদার করতে বসতেন অ্যাসিরিয় সম্রাট অসুরবনিপাল (Ashurbanipal)। ৬৬৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অ্যাসিরিয়ার (Assyria) সিংহাসন ছিল তাঁর দখলে। উল্লেখ্য, তাঁর শাসনকেই অ্যাসিরিয় সাম্রাজ্যের সবচেয়ে জৌলুশময় সময় হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। তাঁর নেতৃত্বেই খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে সর্ববৃহৎ রাজ্যে পরিণত হয়েছিল অ্যাসিরিয়া। পূর্বের পারস্য থেকে পশ্চিমে মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাঁর রাজত্ব। তাঁর সাম্রাজ্যের অধীনে এসেছিল তুরস্কও। 

তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, রাজ্যজয় নয়, সম্রাট অসুরবনিপাল ইতিহাসের পাতায় জনপ্রিয় হয়ে রয়েছেন তাঁর গ্রন্থাগারের (Library) জন্য। হ্যাঁ, বিশ্বের প্রাচীতম গ্রন্থাগার এটিই। প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি গ্রন্থের প্রকাণ্ড এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছিলেন অসুরবনিপাল। রাজপ্রাসাদের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং উত্তর মহলের দ্বিতীয় তলায় বিশেষভাবে তৈরি হয়েছিল এই লাইব্রেরি। তৎকালীন সময়ে, বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও গ্রন্থ-সংগ্রহের নিদর্শন পাওয়া গেছে ঠিকই, তবে অসুরবনিপালের এই লাইব্রেরির বিশেষত্ব হল, বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে গ্রন্থের শ্রেণীবিন্যাস করেছিলেন তিনি। যার মধ্যে ছিল ইতিহাস, প্রশাসন, আইন, চিকিৎসা, কালোজাদু, সাহিত্য, ধর্ম, অর্থনীতি এবং চিঠির সংগ্রহ। পৃথক পৃথক বিষয়ের গ্রন্থের জন্য ছিল আলাদা আলাদা ঘর। এমনকি কোথায় কোন বই রয়েছে, তারও সম্পূর্ণ তালিকা ছিল অসুরবনিপালের এই লাইব্রেরিতে। আর সেই কারণেই গবেষকদের মতে এটি নিছক সংগ্রহশালা নয়, বরং তা প্রাচীতনম ‘আধুনিক গ্রন্থাগার’। ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্য, ‘এনুমা এলিস’, ‘নিমরুড’ কিংবা ‘আজেকা ইন্সক্রিপশন’-এর মতো ঐতিহাসিক পাণ্ডুলিপির কথা আমরা সকলেই শুনেছি কম-বেশি। আশ্চর্যের বিষয় হল এই সমস্ত পাণ্ডুলিপিই ছিল আসলে অসুরবনিপালের বিপুল সংগ্রহের অংশ। আরও অবাক করার বিষয় হল, এই গ্রন্থাগারের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তৈরি হয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার ঐতিহাসিক গ্রন্থাগার। 

আরও পড়ুন
সমস্ত সঞ্চয় ভেঙে ২ লক্ষাধিক বইয়ের গ্রন্থাগার তৈরি তেলেগু সাহিত্যিকের

রাজপরিবারের সমস্ত সদস্য এবং বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য সর্বদাই খোলা থাকত এই লাইব্রেরির দরজা। তবে এই লাইব্রেরির একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন খোদ অসুরবনিপাল। বলতে গেলে, নিজের জন্যই এই লাইব্রেরি বানিয়েছিলেন তিনি। নিত্যদিন বই পড়ার অভ্যাস ছিল অসুরবনিপালের। এমনকি কিউনিফর্ম লিপিতে যথেষ্ট ঝরঝরে ভাষায় লিখতেও পারতেন তিনি। বিশেষত, এই লাইব্রেরি থেকে বই চুরি ঠেকাতে নিজেই কলম ধরেছিলেন সম্রাট অসুরবনিপাল। নিজে হাতে বই-এর শেষে লিখে রাখতেন অভিশাপবাণী। হ্যাঁ, আজকে যাকে ‘বুক কার্স’ বলে জানি আমরা, সেই ‘বুক কার্স’-এরও জনক সম্রাট অসুরবনিপাল। তৎকালীন সময়ে গোটা বিশ্বে পড়াশোনা জানা এমন দ্বিতীয় কোনো শাসক ছিল কিনা, সন্দেহ থেকেই যায়। 

আরও পড়ুন
তৈরি হবে ফ্লাইওভার, ভাঙা পড়তে চলেছে ‘হেরিটেজ’ খোদাবক্স গ্রন্থাগার

তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, অসুরবনিপালের মৃত্যুর পরই ভেঙে পড়ে তাঁর এই প্রকাণ্ড রাজত্ব। জায়গায় জায়গায় শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধে। এমনকি খোদ রাজধানীর ছবিও ছিল একইরকম। সম্রাটঅসুরবনিপালের মৃত্যুর ঠিক ১৮ বছরের মাথায়, ৬১২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গৃহযুদ্ধই পতন ডেকে আনে রাজধানী নিনেভে। রাজপ্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। রাজপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে যায় তাঁর এই লাইব্রেরি। 

আরও পড়ুন
শেক্সপিয়রের লেখা শেষ নাটকের সংস্করণ ‘আবিষ্কার’ স্পেনের গ্রন্থাগারে

তবে মজার বিষয় হল, আগুনে পুড়লেও ছাই হয়ে যায়নি অসুরবনিপালের গ্রন্থ সংগ্রহ। বরং, প্রাসাদে অগ্নিসংযোগ যেন শাপে বর হয়ে দাঁড়ায়। আসলে সে-সময় অ্যাসিরিয়ায় গ্রন্থ লেখা হত কাঁচা মাটির ট্যাবলেটে খোদাই করে। আগুনে ঝলসে গিয়ে শক্ত হয়ে যায় এইসব ট্যাবলেট। এমনকি বেড়ে যায় তাদের আয়ু। 

১৮৪০-এর দশকে, ইরাকের কুয়ুনজিকের প্রত্নতাত্ত্বিকরা সর্বপ্রথম বেশ কিছু পোড়ামাটির ট্যাবলেটের সন্ধান পান নিনেভ শহরে। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই নিনেভে অধিকারিক পাঠায় ব্রিটিশ মিউজিয়াম। প্রত্নতাত্ত্বিক অস্টিন লিন্ডের দৌলতে প্রকাশ্যে আসে আস্ত লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরি আবিষ্কারের কৃতিত্বও পান ব্রিটিশ সাহেব। সে যাই হোক, বর্তমান ইরাকে অবস্থিত এই প্রত্নক্ষেত্র থেকে সবমিলিয়ে উদ্ধার হয়েছে ৩০ হাজারেরও বেশি স্ক্রিপ্ট। ২০০২ সালে এই প্রাচীন গ্রন্থগুলির অনুবাদ তৈরির দায়িত্ব নেয় ইরাকের মসুল বিশ্ববিদ্যালয়। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে চলেছে এই অনুবাদ প্রক্রিয়া। তারপর ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সঙ্গে যৌথভাবে ডিজিটাল রূপ দেওয়া হয়েছে সেগুলিকে। বর্তমানে যার একাংশ সাধারণ মানুষের জন্য ইংরাজি-সহ বিভিন্ন ভাষায় উপলব্ধ ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে…

Powered by Froala Editor

Latest News See More