প্রকাণ্ড হলঘর জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ধাতব সেল্ফ। আর তার প্রতিটি খোপে রাখা সাদা প্লাস্টিকের বালতি। পৃথক পৃথক সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিটি বালতিকে। কিন্তু এত যত্ন সহকারে কী রাখা আছে এই বালতিগুলিতে?
মস্তিষ্ক (Brain)। উত্তরটা শুনলে একটু চমকে উঠতেই হয়। কারণ, সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। সবমিলিয়ে প্রায় হাজারের কাছাকাছি। ডেনমার্কের (Denmark )ইনস্টিটিউট অফ দ্য ব্রেইন প্যাথলজি-তে (Institute Of The Brain Pathology) গেলেই দেখা মিলবে এই আশ্চর্য দৃশ্যের। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ মস্তিষ্ক কেন সংগ্রহ করা হয়েছে সেখানে? সংরক্ষিত এই সকল মস্তিষ্ক আসলে কাদের?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল, ইউরোপে শান্তি ফিরেছিল ঠিকই। তবে পরিসংখ্যান জানান দেয়, এক ধাক্কায় ইউরোপে বৃদ্ধি পেয়েছিল ট্রমা, অ্যালজাইমার, পিটিএসডি, স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো মানসিক অসুখ। এইসব অসুখের প্রকোপ যে আগে ছিল না, এমনটা নয়। তবে যুদ্ধোত্তর ইউরোপে আরও বিশেষভাবে চিকিৎসকদের নজর কাড়ে বিষয়টি। ব্রিটেন, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের মতো দেশ বিশেষভাবে জোর দেয় মানসিক এবং স্নায়বিক চিকিৎসার ওপর।
সে-সময়ই ডেনমার্কের আরহাসে গড়ে উঠেছিল একটি মানসিক হাসপাতাল। ‘রিসকভ সাইকিয়াট্রিক হসপিটাল’-খ্যাত সেই চিকিৎসাকেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে ছিলেন দুই চিকিৎসক— এরিক স্ট্রমগ্রেন এবং ল্যারুস এনারসন। শুধু চিকিৎসাই নয়, ল্যারুস ও এরিক চেয়েছিলেন মৃত মানসিক রোগীদের মস্তিষ্কের ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যেতে। তাতে সায় দিয়েছিল সরকারও। এমনকি সে-সময় ডেনমার্কে বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল মানসিক রোগে প্রয়াত রোগীদের ফরেন্সিক পরীক্ষা।
৫০-র দশকের শেষের দিকে এরিক ও ল্যারুসের সঙ্গে জুটি বাঁধেন আরেক প্যাথোলজিস্ট নাড এজ লরেন্টজেন। তবে লরেন্টজেনের পদ্ধতি ছিল একটু অন্যরকম। মস্তিষ্ক ব্যবচ্ছেদ করে শুধু পরীক্ষানিরীক্ষাই নয়, রীতিমতো নিয়ম মেনে মৃত ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক সংগ্রহ করা শুরু করেন তিনি। ফরেনসিক পরীক্ষার সময়ই, মৃত রোগীদের দেহ থেকে বার করে নেওয়া হত মস্তিষ্ক। তারপর বাইরে থেকে সেলাই করে, দেহ তুলে দেওয়া হত পরিবারের হাতে। সবটাই হত গোপনে। ১৯৫২ থেকে ১৯৮০-র মধ্যে সবমিলিয়ে এভাবে প্রায় ৯৪৭৯টি মস্তিষ্ক সংগ্রহ করা হয়েছিল রিসকভ হাসপাতালের বেসমেন্টে।
আশির দশকের শেষ থেকেই ডেনমার্ক জুড়ে গুজব ছড়াতে থাকে রিসকভ হাসপাতালের এই আশ্চর্য ‘মস্তিষ্ক’ সংগ্রহশালা নিয়ে। প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ততটাও গুরুত্ব দেয়নি। তবে বছর কয়েকের মধ্যেই রীতিমতো রাজনৈতিক রং চড়ে বিষয়টিতে। উঠতে শুরু করে নৈতিকতার প্রশ্ন। ১৯৮৭ সালে নৈতিকতার নিরিখে বিষয়টির তদন্ত করার জন্য ডেনমার্কে তৈরি হয় ‘কাউন্সিল অফ এথিকস’। সে-সময়ই প্রকাশ্যে আসে বিশ্বের বৃহত্তম ‘মস্তিষ্ক’ সংগ্রহশালার অস্তিত্ব।
সেই লড়াই চলছে আজও। অবশ্য ২০১৭-১৮ সালেই বিশেষ বিল পাশ হয়েছিল ‘কাউন্সিল অফ এথিকস’-এ। অযত্নে পড়ে থাকা মস্তিষ্কগুলিকে রিসকভ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইনস্টিটিউট অফ ব্রেইন প্যাথোলজিতে। বর্তমানে সেখানেই রাখা আছে সেগুলি। সেইসঙ্গে তৈরি করা হচ্ছে মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের ডেটাবেস। তাঁদের উত্তরসূরিদের কাছ থেকে অনুমতি পেলে তবেই আগামীদিনে সেগুলি সংরক্ষিত করা যাবে বলেই খাতায়-কলমে রায় দিয়েছে এথিকস কাউন্সিল। অথচ, চার বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও খুব একটা এগোয়নি অনুমতি-আদায়ের কাজ। এই আশ্চর্য সংগ্রহশালা বিজ্ঞানের রাস্তাকে প্রশস্ত করতে পারে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু আরও কতদিন দমিয়ে রাখা হবে মানবাধিকারের আঙ্গিককে? এই প্রশ্নই ঘুরে বেড়াচ্ছে ডেনমার্কের বাতাসে…
Powered by Froala Editor