বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর পোষেন অনেকেই। তবে কোভিড কালীন সময়ে কুকুর পোষার একটা বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল নিঃসঙ্গতা। একাকিত্ব দূর করতে, বিষাদমুক্ত হতেই অনেকে দ্বারস্থ হয়েছিলেন সারমেয়ের কাছে। বিশ্বাস করা খানিকটা কঠিন হলেও, সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণাতেও উঠে এসেছে এমন তথ্য। কুকুরের অনুষঙ্গই নাকি মন ভালো করে দেয় মানুষের। এমনকি বহুক্ষেত্রে শুধু মানুষের শারীরিক চিকিৎসার কাজেও সাহায্য করে কুকুর। অনেকক্ষেত্রে হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম, লাইব্রেরি, এমনকি স্কুলেও বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর রাখা হয় মানুষের সাহায্যের জন্য। তাদেরকে বলা হয় ‘থেরাপি ডগ’ (Therapy Dog)। তবে মজার বিষয় হল, এই বিশেষ শব্দবন্ধটির জন্ম হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষলগ্নে।
স্মোকি দ্য সোলজার (Smoky The Soldier)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম বীর যোদ্ধাদের মধ্যে একজন হিসাবে মনে করা হয় ইয়র্কশায়ার টেরিয়ার প্রজাতির এই বিশেষ কুকুরটিকে। সাধারণভাবে ‘স্মোকি’ নামে পরিচিত হলেও, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থানরত মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনারা ‘ডুডল ড্যান্ডি’ নামেও ডাকতেন তাকে। আর এই স্মোকিই বিশ্বের প্রথম ‘থেরাপি ডগ’।
স্মোকির এই বীরগাথার শুরুয়াত ১৯৪৪ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষের পথে। নিউগিনি, ফিলিপিনস-সহ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে ধীরে ধীরে জাঁকিয়ে বসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পিছু হটছে জাপানি সেনারা। বিশ্বযুদ্ধের এই ময়দানেই আকস্মিক স্মোকিকে খুঁজে পেয়েছিলেন মার্কিন কর্পোরাল বিল ওয়েন। সম্ভবত কোনো ব্রিটিশ সৈনিকের সঙ্গেই নিউগিনিতে এসে হাজির হয়েছিল স্মোকি। তারপর তার মালিকের মৃত্যুর পর, কুকুরটিকে আশ্রয় দেয় এক স্থানীয় বাসিন্দা। বিল যখন প্রথম সাক্ষাৎ পান স্মোকির তখন তার বয়স ৮ মাস। ৬ পাউন্ডের বিনিময়ে ৭ ইঞ্চির ছোট্ট কুকুরছানাটিকে কিনে নেন তিনি।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যুদ্ধের ময়দানে যে-সকল কুকুর সাধারণত ব্যবহৃত হয়, তারা গার্ড ডগ প্রজাতির। অন্যদিকে ইয়র্কশায়ার টেরিয়ার টয় ব্রিড। অর্থাৎ, মালিকের সুরক্ষা করা এই প্রজাতির কাজ নয় মোটেই। তাদের আয়তনও অনেক কম। তাহলে এমন একটি কুকুরকে দত্তক নেওয়ার কারণ কী? না, নিজের সুরক্ষা নয়, বরং যুদ্ধের ময়দানে ‘বন্ধু’ পেতে চেয়েছিলেন কর্পোরাল ওয়েন। আর সেদিক থেকে স্মোকির বিকল্প ছিল না কোনো।
তবে মজার বিষয় হল, টয় ব্রিড হয়েও ওয়েনের সঙ্গে থাকতে থাকতে ক্রমশ যুদ্ধের ময়দানের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে স্মোকি। এমনকি পরবর্তীতে তার জন্যই বেঁচেছিল ২০০-র বেশি প্রাণ। তাছাড়াও সমুদ্রে ভেঙে পড়া বিমান-উদ্ধার, এক সেনাশিবির থেকে অন্য সেনাশিবিরে বার্তা পৌঁছে দেওয়া-সহ একাধিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল স্মোকি। আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গিয়েছিল টাইফুনের মধ্যেও। তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে চিকিৎসার সামগ্রী, জল ও গোলাবারুদ পোঁছে দেওয়ার কাজও করত সে। নানারকম খেলা দেখিয়ে সেনাদের বিনোদন জোগাত অবসর সময়ে। যুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে, সেনাদের সাহায্য করা এবং মূল্যবান রসদ পৌঁছে দেওয়ার কারণেই স্মোকিকে ‘থেরাপি ডগ’-এর তকমা দিয়েছিলেন কর্পোরাল ওয়েন। এমনকি পরবর্তীতে তাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। তাকে বিশেষ পদক প্রদান করেছিলেন ‘অ্যানিম্যালস ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর প্রেসিডেন্ট রবিন হাটনও।
বিশ্বযুদ্ধের শেষে স্মোকি ওয়েনের সঙ্গে ফিরে আসে যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে প্রায় আরও ১২ বছর সে সঙ্গ দিয়েছিল মার্কিন সেনাধ্যক্ষকে। ১৯৫৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মারা যায় স্মোকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ৩০ কেলিব্যারের গুলির বাক্সে করেই তাকে সমাধিস্থ করেছিলেন কর্পোরাল ওয়েন। সেদিন হাজির হয়েছিলেন তাঁর সহযোদ্ধারাও। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে ওহায়োর ক্লিভল্যান্ডে ‘স্মোকি অ্যান্ড ডগস অফ অল ওয়ার্স’ নামে একটি স্মারকও তৈরি করা হয় স্মোকির স্মরণে। স্থাপিত হয় তার প্রমাণ আকারের একটি মূর্তিও। যুদ্ধের মতো ভয়াবহ কঠিন সময়েও যে মানুষকে একা ছেড়ে যায় না সারমেয়— তারই অন্যতম উদাহরণ ‘থেরাপি ডগ’ স্মোকি।
Powered by Froala Editor