শতবর্ষ আগের বিশ্বভ্রমণ, ৪৫০ যাত্রী নিয়ে প্রথম ‘জাহাজ-অভিযান’

পনেরো শতাব্দীর কথা। নতুন দেশ, মহাদেশ আবিষ্কারের নেশায় জাহাজে চেপে বেরিয়ে পড়েছিলেন ইউরোপের অভিযাত্রীরা। তবে পৃথিবীতে সম্পূর্ণ গোল— সেই ধারণা তখনও পর্যন্ত তৈরি হয়নি ইউরোপীয়দের মধ্যে। পরবর্তীতে তাত্ত্বিকভাবে তা প্রমাণিত হলেও, পৃথিবীকে সমুদ্রপথে একবার প্রদক্ষিণ করা সম্ভব কিনা— তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল নানা বিতর্ক। আর তার কারণ ছিল, একেক মহাসাগরের এক এক ধরনের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা।

১৯২২ সালে এসব চ্যালেঞ্জকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই অভিনব এক যাত্রীবাহী ক্রুজের বন্দোবস্ত করে মার্কিন কোম্পানি ‘আমেরিকান এক্সপ্রেস’। ঘোষণা করেছিল সাড়ে চারশো যাত্রীকে গোটা বিশ্ব ঘুরিয়ে দেখাবে তাদের প্যাসেঞ্জার লাইনার এসএস ল্যাকোনিয়া (SS Laconia)। সে-সময় এই মার্কিন কোম্পানির পরিকল্পনাকে অনেকে ‘অবাস্তব’ বলে ঘোষণা করলেও, শেষ পর্যন্ত তা সত্যি করে দেখায় ‘আমেরিকান এক্সপ্রেস’। ১৯২৩ সালের ৩০ মার্চ, অর্থাৎ ঠিক একশো বছর আগে ১৩০ দিনের সমুদ্রযাত্রা সম্পূর্ণ করে, পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে নিউ ইয়র্ক সিটিতে প্রত্যাবর্তন করেছিল এসএস ল্যাকোনিয়া। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যায়, কেমন ছিল বিশ্বের এই প্রথম রাউন্ড-দ্য-গ্লোব ক্রুজ (Round The Globe Cruise)?

এ-ব্যাপারে খানিক আন্দাজ পাওয়া যায় ল্যাকোনিয়ার যাত্রী সংখ্যা দেখেই। সবমিলিয়ে এই জাহাজের ধারণ ক্ষমতা ছিল ২২০০। তবে এই বিশেষ যাত্রার জন্য মাত্র ৪৫০টি টিকিট বরাদ্দ করেছিল সংশ্লিষ্ট সংস্থা। অর্থাৎ, যাত্রীর সংখ্যা কমিয়ে বিলাসবহুল করে তোলা হয়েছিল জাহাজটিকে। প্রতি যাত্রীর জন্য বরাদ্দ ছিল পৃথক পৃথক কেবিন। সঙ্গে জাহাজের মধ্যেই রাখা হয়েছিল বিশেষ বার, রেস্টুর্যান্ট। প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য জাহাজের ডেকে ছিল ঘুমানোর বিশেষ বন্দোবস্ত। রাতের আকাশের নিচে কিংবা হিমশীতল অঞ্চলে সকালে রৌদ্রস্নানের জন্যই এই আয়োজন। 

১৯২২ সালের, ১১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল থেকে যাত্রা শুরু করে এই জাহাজ। তারপর ১৩০ দিনের টানা সমুদ্রযাত্রা। মার্কিন সংবাদপত্র ও বিভিন্ন পত্রিকায় ল্যাকোনিয়ার বিশ্বভ্রমণের আগের ও দেশে ফেরার পরের ঘটনা লিপিবদ্ধ থাকলেও, যাত্রাপথ কিংবা জাহাজের মধ্যে যাত্রীদের অভিজ্ঞতার ব্যাপারে সেভাবে লেখালিখি হয়নি কোথাও। বরং, এই দৃশ্য খাতায়-কলমে লিপিবদ্ধ করেছিলেন ল্যাকোনিয়ারই দুই যাত্রী তথা যমজ বোন— এলিয়ানর ও ক্লডিয়া ফেলপস। 

আফ্রিকা, মিশর, সুয়েজ ক্যানাল, ভারত, জাপান, সিঙ্গাপুর— এলিয়ানর ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন গোটা যাত্রাপথের বিচিত্র সব ছবি। অন্যদিকে ক্লডিয়া খাতায়-কলমে লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতা। না, দেশে ফেরার পর কোনো বিখ্যাত প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়নি এসব লেখা। এলিয়ানরের তোলা ছবিগুলিও প্রকাশ্যে এসেছিল আরও দেড় দশক পর। পরবর্তীতে যা সংরক্ষিত হয় সাউথ ক্যালোরিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুভিং ইমেজ রিসার্চ কালেকশনে। আজও সেখানে ইতিহাসের অংশ হয়েই জীবিত রয়েছে এই যমজ বোনের তোলা ছবি ও লিখিত ডায়েরি। 

আজ গোটা বিশ্বজুড়েই পর্যটনশিল্পের অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে ক্রুজিং। পাশ্চাত্য দেশগুলি তো বটেই, এশিয়ার বহু দেশও কোমর বেঁধে নেমেছে ক্রুজিং ব্যবসায়। আজ থেকে ১০০ বছর আগে এই নতুন ‘যুগ’-এর সূত্রপাত হয়েছিল আদতে ল্যাকোনিয়ার হাত ধরেই। অন্যদিকে ক্লডিয়া এবং এলিয়ানরের দিনলিপিই হয়তো জনপ্রিয় করে তুলেছিল রাউন্ড-দ্য-গ্লোব ক্রুজিংকে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More