শহরে কিছু একটা গোলযোগ যে হয়েছে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল কয়েকদিন থেকেই। সপ্তাহ কাটতে না কাটতেই নাগরিকদের কাছে এসে পৌঁছল সুপারিশ। ছাড়তে হবে শহর। এ যেন এক অলীক ঘটনা। তাও সরকারি আধিকারিকরা বাড়ি বাড়ি এসে বলে যাচ্ছেন শহর ছাড়ার জন্য!
সময়টা ১৯৫৭-৫৮ সাল। সোভিয়েতের ছবির মতো সাজানো পার্বত্য শহর ওজারেক্সের বাসিন্দারা সাক্ষী হয়েছিলেন এমন ঘটনার। অধিকাংশই বিস্মিত হয়েছিলেন সরকারের এমন আচরণে। কারণ, প্রায় দীর্ঘ এক দশক ধরে তাঁদের এই শহরেই কাটাতে হয়েছে বন্দির মতো। রাশিয়ায় থেকেও রাশিয়ার পরিচয়পত্র মিলত না তাঁদের। বাইরে যেতে গেলে নিতে হত বিশেষ অনুমতি। প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদেরও। তবে তাতে সরকারের সঙ্গে বিরোধের কিছুই ছিল না নাগরিকদের। কারণ স্কুল, হাসপাতাল, ব্যাঙ্ক, আবাসন, কারখানা, কাজের সুযোগ, অর্থ— সবকিছুরই পৃথক ব্যবস্থা ছিল ওজারেক্সে। কোটি কোটি টাকা দিয়ে তৈরি এমন শহর হঠাৎ করে খালি করে দেওয়ার পিছনে যে রহস্য রয়েছে কোনো, ভালোরকমই টের পেয়েছিলেন বাসিন্দারা। কিন্তু কী সেই রহস্য?
চের্নোবিল কিংবা ফুকুসিমার কথা প্রকাশ্যে এলেও, রাশিয়ার এই অন্ধকার অধ্যায় ঢাকা দেওয়া হয়েছিল সম্পূর্ণভাবে। পারতপক্ষে ১৯৫৭ সালে উড়াল পর্বতামালার কোলে অবস্থিত এই শহরেই ঘটেছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সম্ভাব্য প্রথম পারমানবিক দুর্ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল রাশিয়া। ততদিন ব্যবহৃত হয়ে গেছে ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বোমা। আর তার সূত্রও চলে এসেছে সোভিয়েতের হাতে। কাজেই দুই দেশের মধ্যে তখন চলছে ঠান্ডা যুদ্ধ।
তবে প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখ এড়িয়েই তো নিতে হবে যুদ্ধের প্রস্তুতি। সেজন্যই রাশিয়া বেছে নিয়েছিল ওজারেস্ক শহরকে। এই শহরেই গড়ে উঠেছিল রাশিয়ার প্রথমদিকের পারমাণবিক কেন্দ্র মায়াক। ১৯৪৫-এর পর থেকেই সেখানে চলত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি এবং পরীক্ষার কর্মসূচি। আর পুরো প্রকল্প গোপন রাখতেই এই শহরকে ম্যাপ থেকে মুছে ফেলেছিল রাশিয়া। এমনকি বাসিন্দাদেরও দেওয়া হত না রাশিয়ার নাগরিকত্ব। অস্থায়ী কাগজই ছিল তাঁদের পরিচয়পত্র।
তবে সিক্রেট প্রোজেক্টের ব্যাপার কঠোর বিধিনিয়ম থাকলেও, বিপজ্জনক পারমাণবিক পদার্থগুলির নিষ্কাশনের ব্যাপারে ন্যূনতম সুরক্ষার কথা সেদিন ভাবেনি স্তালিনের সোভিয়েত। মায়াকের পারমাণবিক গবেষণাগারে উৎপাদিত পারমাণবিক বর্জ্য ফেলা হত নিকটবর্তী টেকা নদীতে। বছর কয়েকের মধ্যেই টেকা নদী-তীরবর্তী গ্রামগুলিতে ক্যানসারের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বর্জ্য নিক্ষেপের স্থান বদল করে সংস্থাটি। শহরের মধ্যেই গড়ে ওঠে ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’। তবে সেই ব্যবস্থাপনাকে আদর্শ পারমাণবিক ডাম্পিং গ্রাউন্ড বলা যায় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
শহরের মধ্যেই একটি নির্মাণে কংক্রিটের বাক্সে ভরে প্রথমে ঠান্ডা করা হত বর্জ্য পদার্থগুলিকে। তারপর তা সংরক্ষণ করা হত ভূগর্ভস্থ চেম্বারে। ১৯৫৭ সালের সেই দুর্ঘটনার পিছনে দায়ী ছিল এই স্টোরেজই। বিকল হয়ে পড়েছিল উত্তপ্ত পারমাণবিক বর্জ্য ঠান্ডা করার যান্ত্রিক কাঠামো। ফলে মুহূর্তে বাষ্পীভূত হয়ে যায় মূল শীতক ‘হেভি ওয়াটার’। আর বর্জ্য হিসাবে নিক্ষেপিত ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়ামের মিশ্রণ ঘনীভূত হয়ে বিস্ফোরিত হয় কংক্রিটে আস্তরণ।
আরও পড়ুন
চের্নোবিল বিস্ফোরণের পরেও ছাড়েননি গ্রাম, আজও আক্ষেপ নেই ৯০ বছরের বৃদ্ধের
নিকটবর্তী ২০০টিরও বেশি শহর ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই তীব্র তেজস্ক্রিয় বিকিরণ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন প্রায় ২ লক্ষ ৭২ হাজার মানুষ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেসরকারি সংস্থাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সংখ্যাটা প্রায় ৪ লক্ষেরও বেশি। যার মধ্যে শুধু ওজারেস্ক শহরের সামান্য কিছু নাগরিককেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অন্যত্র। ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও তা ছিল নামমাত্র।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বহির্বিশ্বের কাছে সম্পূর্ণভাবে অজানা ছিল এই দুর্ঘটনার কথা। ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘে চের্নোবিল দুর্ঘটনার রিপোর্ট প্রকাশের সময়ই সোভিয়েত বাধ্য হয় মায়াক পারমাণবিক কেন্দ্রের এই দুর্ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আনতে। কারণ শুধু চের্নোবিল নয়, আন্তর্জাতিক গবেষকরা পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন রাশিয়ার আরও বেশ কয়েকটি জায়গায়। তার মধ্যে হটস্পট ছিল এই মায়াক।
আরও পড়ুন
এখনও কতটা তেজস্ক্রিয় চের্নোবিল? সন্ধান দেবে রোবট-কুকুর
তবে সবটাই গোপন করা হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। দুর্ঘটনার কথা প্রকাশ্যে আনলে বেরিয়ে পড়ত সোভিয়েতের প্রযুক্তিগত দুর্বলতার বাস্তব ছবি। পাশাপাশি ততদিন মহাকাশে স্পুটনিক পাঠিয়ে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে রাশিয়া। নষ্ট হত সেই ভাবমূর্তিও। আর সেই কারণেই সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে পিছিয়ে আসেন সোভিয়েত শাসক। আজ সাড়ে ৬ দশক পেরিয়ে এসেও যার ক্ষত বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ওজারেক্সের প্রাক্তন বাসিন্দাদের। তিন প্রজন্ম পরেও আজ বিকৃত জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়েই জন্ম নেয় তাঁদের শিশু। সারা দেশের থেকে প্রায় ২৫ গুণ বেশি জন্মকালীন ভ্রুণমৃত্যুর হার। ক্যানসার আক্রান্তের প্রবণতা ৩.৬ গুণ।
তবে দুর্ঘটনার পরেও টনক নড়েনি সোভিয়েতের। আসেনি এতটুকু সতর্কতাও। এই ঘটনার পর বর্জ্য ফেলার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল পাহাড়ের কোলে আবদ্ধ কারাচাই হ্রদকে। যার ফলে ১৯৬৭ সাল নাগাদ আরও একবার দুর্ঘটনার শিকার হয় সোভিয়েত। এই হ্রদ শুকিয়ে গিয়ে পারমাণবিক বর্জ্যের ধূলিকণা ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। পরবর্তীকালে পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, লেকের গর্ভে জমা হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন মিটার গভীর পারমাণবিক পলির আস্তরণ। যার তেজস্ক্রিয়তা প্রায় ১২ কোটি কুরি। সহজ করে বলতে গেলে চের্নোবিল দুর্ঘটনার থেকেও প্রায় দ্বিগুণ এই তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পাথর আর কংক্রিটের সার্কোফেগাসে সম্পূর্ণ ঢেকে দেওয়া হয় এই লেক।
তবে এখানেই শেষ নয়। আজও সক্রিয় রয়েছে রাশিয়ার এই মায়াক কেন্দ্রটি। ২০১৭ সালে ‘রিংস অফ ফাইভ’ নামে একটি গবেষক দল আকস্মিক তেজস্কিয় বিকিরণ লক্ষ্য করেন কাজাখাস্তানের নিকটবর্তী অঞ্চলে। যার উৎস উরাল পর্বতমালা। এমনটাই দাবি জানিয়েছিলেন তাঁরা। ২০১৭-র ২৬ সেপ্টেম্বর মায়াকেই কোনো অঘোষিত বিস্ফোরণ ঘটে গেছিল বলেই মনে করেন অনেকে। তবে তার সত্যতা প্রকাশ্যে আসতে হয়তো সময় লাগবে আরও কয়েক দশক…
আরও পড়ুন
অভিশপ্ত চের্নোবিলের দিকে ক্রমশ এগোচ্ছে দাবানল, অশনি সংকেত ইউক্রেনে
Powered by Froala Editor