মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে বাটা, ট্রেনিং-এর জন্য কারখানা খুলে দিলেন ‘বিদেশি’ ঔডারল্যান্ড

অপারেশন সার্চ লাইট নামে কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড ততদিনে দেখে নিয়েছে বাংলাদেশ। জাতীয়তাবাদের আগুন তো ভিতরে ভিতরে জমে ছিলই। এবার তৈরি হল প্রতিশোধের মানসিকতা। হাজার হাজার বাঙালি যুবক গোপনে তৈরি করে ফেলল ‘মুক্তিবাহিনী’। যুদ্ধ হবে সম্পূর্ণ গেরিলা পদ্ধতিতে। তবে গেরিলা যুদ্ধের প্রথম শর্ত তো গোপনে আক্রমণ সংগঠিত করা। অথচ নিষ্ঠুর খানসেনাদের লুকিয়ে প্রস্তুতির জায়গা কোথায়? তাদের চোখ সর্বত্র ঘোরাফেরা করছে।

ঠিক এই সময়েই অদ্ভুতভাবে এগিয়ে এলেন উইলিয়াম এ এস ঔডারল্যান্ড। না, তিনি বাঙালি নন। পূর্ব-পাকিস্তানে এসেছেন মাত্র বছরখানেক আগে। ১৯৭০ সালে। আন্তর্জাতিক জুতোর কোম্পানি বাটার প্রোডাকশন ম্যানেজার ঔডারল্যান্ড। গোপনে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে নিলেন নিজের কার্যালয়ে। আর তারপর বললেন, পূর্ব-পাকিস্তানে বাটার যত কারখানা আছে, সব কারখানার ভিতর থেকেই চলবে যুদ্ধের প্রস্তুতি। বাঙালি যুবকরা সেদিন মন থেকে বিশ্বাস করেছিল এই বিদেশি মানুষটিকে। আর ঔডারল্যান্ড নিজেও সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছেন অক্ষরে অক্ষরে।

যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ঔডারল্যান্ডের জীবনে নতুন নয়। ১৯১৭ সালে আমস্টারডামে জন্ম ঔডারল্যান্ডের। দারিদ্রের কারণে প্রথাগত শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। ১৭ বছর বয়সে শুরু করেছিলেন জুতো সারাইয়ের জীবিকা। তবে এর মধ্যেই এসে পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানির পরাক্রমী নাৎসি বাহিনী দখল করে নিল নেদারল্যান্ড। অনেকেই নাৎসিদের দলে যোগ দিলেন। কিন্তু ঔডারল্যান্ড পালিয়ে যোগ দিলেন মিত্রশক্তির সঙ্গে। তখনও মিত্রশক্তির জয়ের আশা ক্ষীণ। কিন্তু অত্যাচারী নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালাতেই হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই ইউরোপ ছাড়লেন ঔডারল্যান্ড। একটি জাহাজে চেপে লুকিয়ে চলে এলেন অস্ট্রেলিয়া। নাৎসি আক্রমণ থেকে বাঁচতে তখন এমন অনেকেই অস্ট্রেলিয়ায় এসে আশ্রয় নিচ্ছেন। সেখানেও কিছুদিন জুতো সারাইয়ের কাজ করলেন। আর এভাবেই যোগাযোগ হয়ে গেল আন্তর্জাতিক সংস্থা বাটার সঙ্গে। প্রথম সাধারণ কর্মচারী হয়ে যোগ দিলেন। তারপর নিজের ব্যবসায়িক বুদ্ধির সাহায্যে একে একে প্রতিযোগিতার সিঁড়ি টপকে যেতে থাকলেন।

আরও পড়ুন
'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, আপনারা সর্বস্ব দিয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যান' : বঙ্গবন্ধু

পদোন্নতির সূত্রেই এবারে এসে পড়লেন পূর্ব-পাকিস্তানে। তবে আসার আগে পর্যন্ত সে-দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না। কিন্তু যুদ্ধ যখন শুরু হল, তখন পক্ষ বেছে নিতে হল তাঁকেও। খানসেনাদের অত্যাচার দেখলেন নিজের চোখে। ঠিক যেন নাৎসি বাহিনীরই এক ছোটো সংস্করণ। লড়াই ছাড়া রাস্তা নেই। বাটার কারখানায় শুরু হল সেই যুদ্ধের প্রস্তুতি। আর ঔডারল্যান্ড নিজে ততক্ষণে দায়িত্ব নিয়েছেন যুদ্ধের প্রকৃত খবর আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরার। ইতিমধ্যে অপারেশন সার্চ লাইটের বেশ কিছু ছবি তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন ইউরোপের পত্রিকাগুলিতে। মুক্তি বাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, ওষুধ সবকিছুর জোগানের ব্যবস্থা করলেন ঔডারল্যান্ড।

কিছুদিনের মধ্যেই বদলে যেতে থাকল যুদ্ধের সমীকরণ। আন্তর্জাতিক স্তরে পাক সরকার তখন যথেষ্ট নিন্দার মুখে। মুক্তিবাহিনীকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল ভারতও। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং অসংখ্য মানুষের  প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন হল বাংলাদেশ। আর সেই যুদ্ধেরই শরিক এক বিদেশি। উইলিয়াম এ এস ঔডারল্যান্ড। বাংলাদেশের কাছে তিনি আজও ‘দুঃসময়ের বন্ধু’। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশেই ছিলেন তিনি। তারপর বাটা কোম্পানি থেকে অবসর নিয়ে ফিরে গেলেন অস্ট্রেলিয়া। এর মধ্যে ১৯৯৮ সালে ‘বীর প্রতীক’ পুরস্কার নেওয়ার জন্য তাঁকে ডাকা হলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে উপস্থিত হতে পারেননি। তিনিই একমাত্র বিদেশি, যিনি এই সম্মানে সম্মানিত। ২০০১ সালে পার্থ শহরে মৃত্যু হয় ঔডারল্যান্ডের। তবে তাঁর জীবন প্রমাণ করে দিয়ে যায়, কাঁটাতারের সীমানায় মানুষকে যতই বেঁধে ফেলা হোক, প্রকৃত মানবতার লড়াইটা তার চেয়ে ঢের বেশি আন্তর্জাতিক।

আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More