১৯১৮ সালের শেষ শরতের ইউরোপ। মহাযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে চলে গেছে ব্রিটেন-ফ্রান্স সমন্বিত মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণে। জার্মান নেতারাও তখন পরাজয় সম্পর্কে নিশ্চিত। প্রবল ক্ষমতাধর ফিল্ড মার্শাল পল ভন হিন্ডেনবার্গ ও কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল এরিক ভন লুডেন্ডর্ফের উপর তখন দেশের বৃহত্তর অংশ চরম ক্ষুব্ধ। যুদ্ধশ্রান্ত জার্মান সেনা ও দেশের আমজনতার মধ্যে দেখা দিয়েছে তুমুল অসন্তোষ। তড়িঘড়ি লুডেন্ডর্ফকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় আনা হল চিফ অফ স্টাফ কার্ল উইলহেল্ম গ্রোনারকে। গ্রোনারের প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল অসাধারণ। কেন্দ্রীয় শক্তির অন্যান্য দেশ যেমন বুলগেরিয়া, অটোম্যান সাম্রাজ্য, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরি ততদিনে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই করেছে। শেষপর্যন্ত গ্রোনারের কথাতেই ৬ই নভেম্বর জার্মানির যুদ্ধবিরতির আর্জি মেনে নিল মিত্রশক্তি, তবে শর্ত দিল, যুদ্ধের সমস্ত ক্ষতিপূরণ মেটাতে হবে জার্মানিকেই। সেইদিনই রাজনীতিবিদ মাথিয়াস আর্জবার্গারের নেতৃত্বে একটি জার্মান প্রতিনিধিদল ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে সড়কযোগে রওনা হল।
৮ই নভেম্বর ভোরে উত্তর ফ্রান্সে তাঁদের কনভয় পৌঁছয়। তারপর চূড়ান্ত গোপনীয়তার মধ্যে মিত্রশক্তির সর্বময় নেতা মার্শাল অফ ফ্রান্স ফার্দিন্যান্দ ফশের ব্যক্তিগত ট্রেনে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় পিকার্দি অঞ্চলের কম্পিয়েনিয়ে অরণ্যে। ফার্দিন্যান্দ ফশ তাঁদের হাতে মিত্রপক্ষের শর্তাবলি তুলে দিয়ে বাহাত্তর ঘণ্টা সময় দেন। তিন দিন ধরে আলোচনা চলে দুই পক্ষে। ১১ই নভেম্বর ভোর পাঁচটায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় জার্মানি। রণাবসান চুক্তিতে মিত্রশক্তির পক্ষ থেকে সই করেন ফার্দিন্যান্দ ফশ ও ব্রিটিশ নৌসেনাপতি রোজলিন উইমিস এবং জার্মানির পক্ষ থেকে স্বাক্ষরকারীরা ছিলেন মাথিয়াস আর্জবার্গার, বিদেশমন্ত্রকের প্রতিনিধি কাউন্ট আলফ্রেড ভন অবার্নডর্ফ, মেজর জেনারেল ডেটলফ ভন উইন্টারফেল্ট ও নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন আর্ন্সট ভেন্সোলো। ওইদিন বেলা এগারোটায় সমগ্র ইউরোপে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হল। এগারোতম মাস, এগারোতম দিন, এগারোতম ঘণ্টায় সমাপ্ত হল মানবসভ্যতার ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম যুদ্ধটি।
যুদ্ধের সরাসরি প্রভাবে সেনা ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৬ লক্ষ, জেনোসাইড ও মহামারীর প্রকোপে মৃত আরও ৫ থেকে ১০ কোটি। মৃত্যুসংখ্যার নিরিখে সেই সময়ের তুলনায় ‘ভয়ঙ্করতম’ যুদ্ধ হলেও প্রকৃত বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের রূপ কী হতে পারে, তা বিশ্ববাসী টের পাবে আর দু’দশক বাদেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অপমানকর পরাজয়, গণ-বিদ্রোহ, ভার্সাই চুক্তির লজ্জা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল যে দেশটিকে, দু’দশক বাদে তারাই হয়ে ওঠে পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি। ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে প্রায় নিজ-হাতে টেনে তুলেছিলেন অ্যাডলফ হিটলার ও তাঁর কর্তৃত্বাধীন নাৎসি দল। কিন্তু স্বদেশকে ‘জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন’ দিতে গিয়ে জার্মান ব্যতীত অন্য সব জাতিকে নিকৃষ্ট নজরে দেখতে শুরু করলেন তাঁরা। ক্ষমতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছিল বিরোধী কমিউনিস্ট, ইহুদি, সমকামী, মানসিক প্রতিবন্ধী ও বিকলাঙ্গদের মতো ‘অস্বাভাবিক’দের ধরে ধরে খুন। সদা-উচ্চাকাঙ্খী হিটলার চাইতেন, একদিন সমগ্র ইউরোপ তাঁর হাতের মুঠোয় আসবে। সেই অভিলাষে ক্ষমতায় আসার ছ’বছরের মধ্যেই খর্বকায়, মাছি গোঁফধারী লোকটি লাগিয়ে দিলেন আরেকটি যুদ্ধ। প্যানজার বাহিনীর টাইগার ট্যাঙ্কের তোপধ্বনিতে যেন ধ্বনিত হতে লাগল ফ্যাসিবাদী আস্ফালন।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চরমে, ‘শত্রুপক্ষ’ আমেরিকার বুকে মার্চ করলেন হিটলার!
পশ্চিম পোল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডসের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলি দখলের পর টাইগার ট্যাঙ্কের মুখ এবার ঘুরল শক্তিধর ফ্রান্সের দিকে। ১৯৪০ সালে, নেদারল্যান্ডস দখলের দিনই ১০ই মে ফ্রান্স-জার্মান সীমান্তের দুর্ভেদ্য ম্যাজিনো লাইন অতিক্রম করে গেল জার্মানরা। এরপর পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা অরক্ষিত আর্দেন অঞ্চল দিয়ে উত্তর ফ্রান্সে ঢুকে এল নাৎসিবাহিনী। ৩রা জুন জার্মান বোমারু বিমানের আক্রমণে আক্রান্ত হল প্যারিস। নিশ্চিত পরাজয় দেখে প্রধানমন্ত্রী পল রেনোউ দুই বৃদ্ধ রাজনীতিবিদকে সর্বোচ্চ পদে বসালেন। সর্বময় সেনাপ্রধান হলেন তিয়াত্তর বছর বয়সী ম্যাক্সিম উইগাঁ, আর উপ-প্রধানমন্ত্রী হলেন চুরাশি বছর বয়সী অঁরি ফিলিপ পেতাঁ। দুজনেই যুদ্ধবিরতির পথ খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে ১৪ই জুন প্যারিসের পতন হল নাৎসিদের হাতে।
আরও পড়ুন
জার্মানি ছেড়ে, আমেরিকার হয়ে কাজ করেছিলেন হিটলারের ‘প্রিয়’ বিজ্ঞানীরাই!
১৬ই জুন প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিলেন পল রেনোউ, প্রধানমন্ত্রী হলেন অঁরি ফিলিপ পেতাঁ। গঠিত হল ভিশি ফ্রান্স। যুদ্ধ চলাকালীন জার্মানির পাশে থাকবে ভিশি ফ্রান্স, এই চুক্তিতে জার্মানদের সঙ্গে সমঝোতা করতে সম্মত হলেন প্রধানমন্ত্রী পেতাঁ। ২২শে জুন ফ্রান্স-জার্মানির মধ্যে স্বাক্ষরিত হল যুদ্ধবিরতি চুক্তি। কোথায়? সাড়ে একুশ বছর আগে যেখানে বিজয়ী মিত্রশক্তির সমস্ত শর্ত মেনে নিয়ে ফ্রান্সের মার্শাল ফার্দিন্যান্দ ফশের সামনে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করেছিলেন জার্মান প্রতিনিধিরা, সেই কম্পিয়েনিয়ে অরণ্যের ওই বিশেষ জায়গাটিতেই। এহেন কৌশলগত স্থান নির্বাচনটি করেছিলেন স্বয়ং ফ্যুয়েরার। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অপমানের সমুচিত প্রতিশোধ নেওয়া। তবে শুধু স্থান নির্বাচন করেই ক্ষান্ত থাকেননি হিটলার, সেবার যে বিশেষ রেলের কামরাটিতে করে এসেছিলেন সকলে, যেখানে ছিল মার্শাল ফশের অস্থায়ী দপ্তর, সেই কামরাটিকেও আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। সেলুন গাড়িটি তখন ঠাঁই পেয়েছে সামান্য দূরে নির্মিত ‘গ্লেড অফ দি আর্মিস্টিশ’ সংগ্রহশালায়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর গাড়িটিকে বিজয়-স্মারক হিসাবে বার্লিনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মিত্রবাহিনীর অগ্রসর দেখে জার্মান এসএস বাহিনী সেটিকে জ্বালিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন
‘আমার কারোর থেকে উপদেশ নেওয়ার প্রয়োজন নেই’, হিটলারকে জবাব সুভাষচন্দ্রের
একই অরণ্যে একই উদ্দেশ্য নিয়ে দুই প্রতিপক্ষ মিলিত হয়েছিল সাড়ে একুশ বছরের ব্যবধানে। পার্থক্যের মধ্যে, সেবার বিজয়ী ছিল ফ্রান্স। দেওয়া-নেওয়ার এমন অদ্ভুত সমাপতন বুঝি ইতিহাসেই সম্ভব।
Powered by Froala Editor