একটানা ৬৪ দিন উড়ান, ৬০ বছর পেরিয়েও ভাঙেনি যে রেকর্ড

২০২২ সালের আগস্ট মাসের কথা। সংবাদপত্রের শিরোনামে জায়গা করে নিয়েছিল ‘জেফির’ নামের একটি সৌরশক্তি চালিত ড্রোন। ৬৪ দিন ১৮ ঘণ্টা ২৬ মিনিট একটানা উড়ান নিয়ে তৈরি করেছিল এক নতুন নজির। তারপরই যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে অ্যারিজোনার কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে ভেঙে পড়ে এই ড্রোন। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, টানা ৬৪ দিন ওড়ার পরও মাত্র ৪ ঘণ্টার জন্য দীর্ঘতম উড়ানের বিশ্বরেকর্ড স্পর্শ করা অধরাই থেকে যায় ‘জেফির’-এর। তাও আবার সেই রেকর্ড তৈরি হয়েছিল, আজ থেকে নাকি ৬৪ বছর আগে!

রূপকথার গল্প নয়। নয় দুঃসাহসিক অভিযানের কোনো চলচ্চিত্রও। এই আশ্চর্য কীর্তির নেপথ্যে রয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ব্যবসায়ী। রবার্ট টিম। তবে রবার্ট একা নন, দীর্ঘতম উড়ানে রবার্টের সহ-চালক ছিলেন জন কুক। প্রশ্ন থেকে যায়, একটানা ৬৪ দিনের উড়ানে তবে কী খেয়েছিলেন তাঁরা? কীভাবেই বা জ্বালানি সংগ্রহ করেছিলেন এত দীর্ঘ উড়ানের (Longest Flight) জন্য? কারণ, তখনও যে সৌরশক্তিতে বিমান চালানোর কথা ভাবা যায় না স্বপ্নেও। তবে?

শুরু থেকেই বলা যাক ঘটনাটা। ১৯৫৬ সাল। লাস ভেগাসের দক্ষিণে প্রকাণ্ড এক বিলাসবহুল হোটেল এবং ক্যাসিনো তৈরি করে হাসিন্ডা গ্রুপ। এই হাসিন্ডা হোটেলেরই কর্মচারী ছিলেন প্রাক্তন বিশ্বযুদ্ধের সেনানী তথা যুদ্ধবিমান চালক রবার্ট টিম (Robert Timm)। হোটেলের প্রচারের জন্য তাঁর কাছে দ্বারস্থ হন হাসিন্ডা গ্রুপের কর্মকর্তারা। দাবি রাখেন, হাসিন্ডা হোটেলের চিহ্নবহ বিমানে চেপে গোটা একটানা উড়ানের বিশ্বরেকর্ড করতে হবে তাঁকে। তার জন্য ১ লক্ষ মার্কিন ডলার পারিশ্রমিকও পাবেন তিনি। তখনকার দিনের হিসাবে অঙ্কটা মোটেই কম নয়। ফলে, রাজি হয়ে যান টিম।

তখনও পর্যন্ত দীর্ঘতম উড়ানের বিশ্বরেকর্ড ছিল ৪৭ দিন। সেই রেকর্ড ভাঙার লক্ষ্যেই কর্মযজ্ঞ শুরু করেন টিম। কর্মযজ্ঞ বলতে, চার আসনের ‘সেসনা-১৭২’ বিমানের খোলনলচে বদলে ফেলা। প্রথমত, তিনি বদলে ফেলেন এই বিমানের ট্যাঙ্ক। আয়তন বাড়ানো হয় তার। পাশাপাশি পিছনের দুটি আসন বাদ দিয়ে সেখানে রাখা হয় খাবার তৈরির বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রাখার একটি ট্রাঙ্ক এবং জলের ট্যাঙ্ক। তাছাড়া বিমানের পিছনের অংশে ‘পোর্টেবল’ শৌচাগারও তৈরি করেন টিম। ‘পোর্টেবল’ বলা এই কারণেই, কেন-না এই শৌচাগারে আদতে কোনো নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল না। বদলে মল-মূত্র জমা হত প্লাস্টিকের বিনব্যাগে। মরুভূমি বা সমুদ্রের ওপর দিয়ে ওড়ার সময়, সেই ব্যাগ নিচে ফেলে দিতেন টিমরা। আর নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানির সরবরাহ? 

আরও পড়ুন
১৮ বছর ধরে বসবাস বিমানবন্দরেই, প্রয়াত ‘দ্য টার্মিনাল ম্যান’

সেটার জন্য অভিনব ব্যবস্থা করেন টিম। যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, কানাডা এবং মেক্সিকোর বিশেষ কিছু জায়গা বেছে নিয়ে, সেখানে মোতায়েন করেন বেশ কিছু ট্যাঙ্কার ট্রাক। কোনোটায় রাখা হত গ্যাসোলিন, কোনোটায় আবার পানীয় জল। হাইরোডের ওপর দিয়ে কম উচ্চতায় এবং কম গতিতে ওড়ার সময়ই, এই ট্রাক থেকেই সরাসরি পাইপের মাধ্যমে তেল ও জল ভরার ব্যবস্থা করেন টিম। পাশাপাশি বিমানে পুলির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল খাবারের সরবরাহ বজায় রাখতে।

আরও পড়ুন
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম বিমান-রুট, দৈর্ঘ্য মাত্র ২ মাইল!

ঐতিহাসিক এই উড়ানের নীলনকশা তৈরির পর, ১৯৫৮ সালে প্রথমবার উড়ান নেন টিম এবং কুক। তবে অধরাই থেকে যায় লক্ষ্য। একবার নয়, পর পর তিন বার। প্রতিবারে উড়ানের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেলেও, ১৭ দিনের গণ্ডি পেরোতে পারেননি তাঁরা। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে শেষ করতে হয়েছিল উড়ান। তবে শেষ অবধি সংশ্লিষ্ট হোটেলটি হাত গুটিয়ে নিলেও হাল ছাড়েননি টিম। উড়োজাহাজে বেশ কিছু বদল করে ফের উড়ান দেন ১৯৫৮ সালের ৪ ডিসেম্বর।

আরও পড়ুন
মাত্র ১৯ বছর বয়সে একা বিমানে বিশ্বজয়, রেকর্ড বেলজিয়ামের তরুণীর

লাস ভেগাসের ম্যাককারান বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়েছিল সেই দুঃসাহসিক যাত্রা। হ্যাঁ, দুঃসাহসিকই বটে। কারণ, ৬৪ দিন ২২ ঘণ্টা ১৯ মিনিটের এই উড়ানে কম ঝড়ঝাপটা বয়ে যায়নি কুক এবং টিমের ওপর দিয়ে। প্রথমত, ইঞ্জিনের অবিরাম শব্দ, এরোডাইনামিক কম্পন— পালা করে বিমান চালানোর কথা থাকলেও, সেভাবে বিশ্রামের সুযোগ পাননি কেউ-ই। এমনকি তন্দ্রা এসে যাওয়ায় একবার ঘুমিয়েও পড়েছিলেন দুই চালক। এক ঘণ্টারও বেশি সময় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে উড়েছিল সংশ্লিষ্ট বিমানটি। তাছাড়া ৩৯তম দিনে বন্ধ হয়ে যায় বিমানের বৈদ্যুতিক পাম্প। ফলে, জ্বালানি ভরা কার্যত অসম্ভব হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে সেটাও করতে হয়েছে পুলির মাধ্যমে। 

অভিযান আরও দীর্ঘ হতে পারত, তবে ইঞ্জিন গরম হয়ে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধান চালক টিম। ১৯৫৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাককারান বিমানবন্দরে অবতরণ করে টিম ও কুকের ছোট্ট বিমান। তৈরি হয় এক নতুন ইতিহাস। সবমিলিয়ে দু’মাসে তাঁরা উড়েছিলেন দেড় লক্ষ মাইল পথ। সেই রেকর্ড নব্বই-এর দশকে ভেঙে গেলেও, আজও ২ মাস একটানা ওড়ার রেকর্ড স্পর্শ করতে পারেনি কোনো বিমানচালক, এমনকি ড্রোনও। 

তবে ওই যে কথায় আছে না, ‘কষ্ট বিনা কেষ্ট নাই’। এও তেমনই। বিশ্বরেকর্ড তৈরির জন্য মাশুলও গুনতে হয়েছে টিম ও কুক— দু’জনকেই। বিমানের ইঞ্জিনের একটানা আওয়াজে ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছিলেন কুক। মনোবিদের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল তাঁকে। অন্যদিকে টিম আক্রান্ত হয়েছিলেন স্পনডিলোসিসে। এমনকি কুক এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, এই বিমানযাত্রা ছোট্ট টিনের কৌটোয় হাত-পা মুড়ে বসে থাকার মতোই। হাসতে হাসতে জানান, পরবর্তীতে টিম আবার এধরনের উদ্যোগ নিলে, প্রথমেই প্রত্যাখ্যান করে দেবেন তিনি। তবে মজার বিষয় হল, দ্বিতীয়বার সেই সাহস নিজেও দেখাননি রবার্ট টিম…

Powered by Froala Editor