বাংলার গ্রামগঞ্জ মানেই নানান লোকশিল্পের গল্প। শহর থেকে মাইলের পর মাইল পার করে কোনো গ্রামে পৌঁছে গেলে কোনো এক গাছের তলায় পাওয়া যাবে কোনো বৃদ্ধকে, যার গলায় হয়তো অপূর্ব কোনো গ্রামীণ সুর, মাটির সুর। আবার অন্য কোনো প্রান্তে মিলবে অন্য সুরের তালে অপূর্ব কোনো নাচের ভঙ্গিমা। লোকশিল্পের এই বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে। সেরকমই এক ঐতিহ্যের সাক্ষী নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল। ছায়ায় ঘেরা, সবুজে মোড়া ছোট্ট এক গ্রাম, কিন্তু অদ্ভুত রঙিন একটি গ্রাম। গোটা গ্রামের কাঠের পুতুলের রঙের বাহার গ্রামকে যেন আরও রঙিন করে তোলে। আর সেই রঙের ছোঁয়ায় গোটা গ্রামকে যেন জীবন্ত করে তোলে গ্রামের মেয়েরা। পুরুষদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে শুধু নিজেদের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা নয়, পাশাপাশি এক প্রাচীন শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এক অদম্য লড়াই করে চলেছে। করোনা নামক করাল থাবার সামনে যখন গোটা শিল্পজগত দিশাহীন, এক ছোট্ট গ্রামের লড়াকু ঐ মেয়েগুলো সেই থাবার সামনেই বুক চিতিয়ে লড়াই করার উদাহরণ তৈরি করতেই পারে।
পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার নতুনগ্রাম। গোটা গ্রামটি পরিচিত একটিই কারণে - এই গ্রামের তৈরি কাঠের পুতুল জগত বিখ্যাত, বিশেষত নানান আকারের পেঁচা । গ্রামে ঢুকে খানিক এগোতেই চোখে পড়বে প্রতিটি ঘরের দালানে সারি সারি দিয়ে রকমারি পুতুল, নানান রং দিয়ে সজ্জিত। শুধু রঙের বৈচিত্র্যই নয়, তাদের আকারে ও আকৃতিতেও আছে চমক। কাঠ কেটে তাকে খোদাই করে ত্রিমাত্রিক আকার দেওয়া হয়। সঙ্গে তার ওপরেই চলে নানান নকশা। আম, কাঁঠাল এরকম নানান গাছের কাঠ কেটে আনেন পুরুষেরা। তারপর সেগুলো খোদাই করে নকশার কাজ তাঁরা করেন। বাকি রং লাগানো, সাজানো এবং বিক্রি করার বেশিরভাগটাই করেন মহিলারা। বিভিন্ন রকমের পুতুল, মূর্তি বানান তাঁরা। রাজা-রানির পুতুল, নানান ভগবানের কাঠের মূর্তি বানিয়ে থাকেন তাঁরা।
মূলত সূত্রধর নামে পরিচিত এই গ্রামের মানুষেরা। বংশপরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন। তবে কাঠ দিয়ে নয়, এই লোকশিল্পের শুরু পাথর দিয়ে। বহু বহু আগে তাদের পূর্বপুরুষেরা পাথরের মূর্তি বানাতেন। তখন তাঁরা ব্যবহার করতেন ভাস্কর উপাধি। শোনা যায়, স্থানীয় রাজার অনুরোধেই প্রথম কাঠের কাজ শুরু হয়। পরবর্তীতে সেই কাজ ধারাবাহিক ভাবে চলতে থাকে। এখনও অনেকে ভাস্কর উপাধি ব্যবহার করে থাকেন। কথা হল গৌড় সূত্রধরের সঙ্গে, জানালেন ছয় পুরুষ ধরে তারা এই কাজ করছেন। তার ছেলে অক্ষয় সূত্রধরও এখন বাবাকে কাজে সাহায্য করেন। গৌড় বললেন “নানান মূর্তি আমরা বানিয়ে থাকি, তবে আমাদের গ্রামের সবথেকে বেশি প্রচলিত মূর্তি হল প্যাঁচার মূর্তি।” অত্যন্ত সুদক্ষ হাতে যত্ন নিয়ে এক একটি মূর্তি খোদাই করেন। এক একটি মূর্তি বানাতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে যায়। গৌড়ের ছেলে অক্ষয় জানান, “যে পরিমাণ পরিশ্রম হয়, সেইমতো দাম পাই না। তবুও পারিবারিক কাজ, বাপ দাদুর তৈরি করা শিল্প, বালিয়ে নিয়ে যেতে মন চায়।”
আরও পড়ুন
গাছে-গাছে ঝুলছে ভয়ঙ্কর সব পুতুল, স্ট্যাফোর্ডশায়ারের অরণ্যের রহস্য আজও অমীমাংসিত
গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে চলে মূর্তি, পুতুল বানানোর আর রং করার কাজ। রং করেন পরিবারের মহিলারা। শুধু রং না, পাশাপাশি সেই পুতুল বিক্রির সিংহভাগ কৃতিত্বও তাঁদেরই। গ্রামে টুরিস্ট আসা লেগেই থাকে। তাদের সামনে সেই মূর্তি পরিবেশন, খদ্দের সামলানো, হিসেব রাখা সমস্ত কাজ মহিলারাই করেন। বাপের বাড়িতে কখনও এসব করেননি কিন্তু এখন বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে শ্বশুরবাড়িতে এসে শিল্পের টানেই রং তুলি হাতে নিয়েছেন ৩৮ বছরের রুপালি সূত্রধর। রুপালি জানান, বিয়ের পর থেকেই স্বামী-শ্বশুরকে এই কাজ করতে দেখছেন। তাদের সাহায্যও করার তাগিদেই এখন এই কাজে নেমে পড়া। রীতিমতো দক্ষ হাতে ব্যবসা সামলান তিনি। শুধু ঘরে বসে বিক্রি না, প্রয়োজনমতো কাজ কুরিয়ার করতেও সক্ষম এই গৃহবধূ।
আরও পড়ুন
দুষ্প্রাপ্য পুতুল, এরোপ্লেন থেকে প্রাচীন মুদ্রা, পার্ক স্ট্রিটের গুপ্ত খাজানা
আরও পড়ুন
একসময় গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরত, আজ হারিয়ে যেতে বসেছে সাঁওতালি ‘চাদর-বাঁধনী’ পুতুল নাচ
সময়ের তাগিদে চাহিদা বাড়ে। বদলায় রুচি। তাই শুধু পুতুলেই আটকে নেই নতুনগ্রাম। এখন হরেক রকম কাঠের জিনিস তারা বানাচ্ছে। চেয়ার, টেবিল, ঘড়ি, এমনকি চা রাখার ট্রে পর্যন্ত বানাতে শুরু করেছেন। প্রতিটি জিনিসেই কিন্তু আছে নতুনগ্রামের সেই রঙিন ছাপ। বর্তমানে এই লোকশিল্পকে ধরে রাখার জন্য শেষ বেশ কয়েক বছর ধরে সরকার ও নানান সংগঠন মেলার আয়োজন করে। এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে UNESCO থেকেও সাহায্যও মেলে। রুপালি জানালেন, সেসব মেলায় পুতুলের যেমন চাহিদা থাকে, তার পাশাপাশি এইসব নতুন জিনিসেরও বাজার নেহাত কম নয়। আর রঙিন হওয়ার কারণে মানুষের কাছে বেশ মনগ্রাহীও।
এই গ্রামেরই এক শিল্পী শম্ভুনাথ দেশের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর পরিবারের লোকজন এখন বিভিন্ন জায়গায় ওয়ার্কশপ করেন, যাতে এই শিল্পধারাকে আগামীতেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। খ্যাতির কারণেই হোক, কিংবা নানান মেলায় প্রচার, নতুনগ্রামের এইসব জিনিসের প্রসার বেশ ভালোই। শুধু আশেপাশের গ্রাম কিংবা কলকাতা না, এই গ্রামের জিনিস বিদেশ পর্যন্ত ধাওয়া করে। তবে অন্যান্য সমস্ত শিল্পের মতোই এই শিল্পীদের জীবনেও বিপদ ঘনিয়ে এনেছে করোনা ভাইরাসের থাবা। বিশ্বব্যাপী মহামারী ইতিমধ্যেই কেড়ে নিয়েছে তাঁদের ব্যবসার সুযোগ। লম্বা সময় ধরে বন্ধ সমস্ত মেলা। লকডাউনের জন্য টুরিস্ট আসেনি বহুদিন। তাই বহু শিল্পীর মাথায় হাত। ঘরে বানানো রয়েছে বিক্রি না-হওয়া একগাদা পুতুল।
এরই মাঝে নতুন করে বিপদ হিসেবে এসেছে করোনা সংক্রমনের দ্বিতীয় ঢেউ। শঙ্কিত সকলেই - কীভাবে এই কঠিন সময়ে দিন চালাবেন তাঁরা নিজেরাও জানেন না, এমনটা জানালেন গ্রামের আর এক শিল্পী বৃন্দাবন সূত্রধর। বললেন “কবে শেষ মেলা করেছি মনে নেই, সেখানেই বড়ো রকমের ব্যবসা হয়েছে। তারপরে লকডাউন ওঠার পর কিছু মেলা হয়। কিন্তু আগের মতো খরিদ্দার নেই, বিক্রি নেই।” একই সুর জবা ভাস্কর, ভাগ্যবতী ভাস্করদের মুখে। পুতুল থেকে তেমন আয় হচ্ছে না দেখে জবা বাড়ির সামনে নতুন মুদিখানার দোকান দিয়েছে। আশা যদি অল্প কিছু আয় বাড়ে। ভাগ্যবতী নতুন করে পুতুল বানানো বন্ধ করে দিয়েছেন। যেদিন সমস্ত বিপদ কাটবে সেদিনই আবার তিনি কাজে নামবেন। তবুও নতুন দিনের জন্য আশাবাদী বৃন্দাবনের মেয়ে ১৯ বছরের হরিপ্রিয়া। বাবার এই কাজে সে সর্বক্ষণের সঙ্গী। রং করার কাজে মাকে সমানে সাহায্য করা, পাশাপাশি পড়াশুনা চালানো একইসঙ্গে বজায় রাখেন।
শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার এক অদম্য উৎসাহ গ্রামে সকলের মধ্যেই রয়েছে, আর সেই আশাতেই হয়তো নতুনগ্রাম আবার সব বিপদ কাটিয়ে নতুন করে পুতুল রপ্তানি শুরু করবে। হাওড়া স্টেশন থেকে কাটোয়া লোকাল ধরে অগ্রদ্বীপ স্টেশন। তারপর কিছুটা পথ এগিয়ে নতুনগ্রাম। শান্তিনিকেতন থেকেও ঘুরপথে আসা সম্ভব। গ্রামে শিল্পীদের ঘরেই খানিক পয়সার বিনিময়ে মিলবে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত। করোনা চলে গেলে একবার ঘুরে আসবেন নাকি?
Powered by Froala Editor