“অনেকক্ষণ পর্যন্ত নাবিকেরা নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিল। যাত্রীরা ভয়ে কণ্ঠাগত প্রাণ। বেশি বাতাস নাই। সুতরাং তাঁহারা তরঙ্গান্দোলনকম্প বড় জানিতে পারিলেন না। তথাপি সকলেই মৃত্যু নিকট নিশ্চিত করিলেন। পুরুষেরা নিঃশব্দে দুর্গানাম জপ করিতে লাগিলেন, স্ত্রীলোকেরা সুর তুলিয়া বিবিধ শব্দবিন্যাসে কাঁদিতে লাগিল। একটি স্ত্রীলোক গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন করিয়া আসিয়াছিল, ছেলে জলে দিয়া আর তুলিতে পারে নাই,- সেই কেবল কাঁদিল না…”
‘কপালকুণ্ডলা’-র প্রথম পরিচ্ছেদের এই অংশটি অনেকেরই মনে থাকবে। মনে থাকবে নবকুমারের সেই বিখ্যাত উক্তি। এই ছোট্ট অংশে অনেক বর্ণনাই দিয়েছিলেন বঙ্কিম। যেখানে ছিলেন এক মহিলাও। গঙ্গাসাগরে নিজের সন্তানকে ভাসিয়ে দিতে এসেছিলেন। নৌকোয় দিকভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও সেই শোকে থাবা বসাতে পারেনি।
শুধু গল্প-উপন্যাসের কাল্পনিক কথন নয়, একটা সময় বাংলায় নদীতে সন্তান বিসর্জন দেওয়া হত। মহা পুণ্যস্থান গঙ্গাসাগরও এর ব্যাতিক্রম নয়। গঙ্গার জলে দাঁড়িয়ে কেউ তাঁদের সন্তানকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন, এমন ঘটনা তো অত্যন্ত সাধারণ ছিল। সেই সময়ের অনেক বই, জার্নালে এর পরিসংখ্যানও দেওয়া আছে। হিউজ মারে তাঁর বইয়ে লিখেছেন, একসময় ভারতে দু’বছরে মোট ৫০০টি সন্তান বির্জনের ঘটনা ঘটেছিল। কোনো কোনও জায়গায় হাজারও ছাড়িয়েছে।
শুধুমাত্র ধর্মপালনের জন্য নয়, এমন নৃশংস ঘটনার পেছনে ছিল সেই সময়ের কুসংস্কার। প্রথমত, কন্যা সন্তান হলে তাকে গঙ্গাসাগরে বা অন্য কোথাও ভাসিয়ে দেওয়ার চল তো ছিলই।
এছাড়াও, বিয়ের পর বহুদিন অপুত্রক থাকার পর কারোর সন্তানাদি হলে, প্রথম সন্তানকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়াই ছিল ‘রীতি’। অনেক সময় গভীর সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে, অনেক সময় সদ্যোজাত অবস্থাতেই ভাসিয়ে দিয়ে ফিরে আসত মা-বাবা। কিছু ক্ষেত্রে সেই শিশুরা বেঁচে যেত, তবে অনেকেরই ভাগ্য ছিল কুমিরের খাবার হওয়া। অবশ্য ১৮০২ সালে লর্ড ওয়েলেসলি আইন করে এই ঘৃণ্য প্রথা বন্ধ করে দেন।
তবে এই ঘটনা থেমে এলেও বদলায়নি তার রূপক। এখনও অনেকেই সন্তানকে ভাসিয়েই তুলে নেন। কেউ কেউ প্রতীক হিসেবে ভাসান অন্যান্য দ্রব্যাদি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেহারা হয়তো বদলেছে, কিন্তু কুসংস্কারের মূলে কতটা বদল এসেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
তবে এই ঘটনা সরিয়ে রাখলে, গঙ্গাসাগরের ‘মাহাত্ম্য’ নিছক কম নয়। গঙ্গাসাগর মানেই পুণ্যার্থীদের কাছে একতি তীর্থ। গঙ্গাসাগরের সাগরসঙ্গম এবং কপিল মুনির আশ্রম সেই পুরাণ কাল থেকেই হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে গঙ্গার স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আগমন বৃত্তান্ত। সেই কাহিনি তো ছোটবেলা থেকেই পড়ে এসেছি আমরা।
তবে এখন অনেক সুগম হলেও, এককালে বেশ কঠিনই ছিল গঙ্গাসাগর যাত্রা। শুধু কঠিন নয়, বলা ভাল দুরূহ। হয় ঘন বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে, নয়তো নৌকা করে জলপথে— যাওয়ার রাস্তা বলতে ছিল এই দুটিই। ঝড় বৃষ্টির আশঙ্কা তো ছিলই, সঙ্গে হিংস্র পশুর আক্রমণ, জলদস্যু, ডাকাতের ভয়, এবং অসুখ—বিপদ যেন সবদিক থেকে ঘিরে ছিল।
কেউ কেউ মনে করেন, এত বিপদের কারণেই হয়ত অতীতে কাশী বা হরিদ্বারের মতো জনপ্রিয় হয়নি গঙ্গাসাগর। কার্যত পরিজনদের কাছে শেষ বিদায় নিয়েই সাগরসঙ্গমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতেন তীর্থযাত্রীরা। অনেকে ফিরতেও পারতেন না, রাস্তাতেই দেহ রাখতেন। আজকের সাগরদ্বীপ এবং গঙ্গাসাগর মেলা দেখলে কি মনে পড়বে তখনকার এই বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতির কথা?
ঋণ - প্রবাসী - ষড়বিংশ ভাগ, প্রথম খণ্ড (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ)
বাংলায় ভ্রমণ (১৯৪০)
Powered by Froala Editor