১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাস সেটা। সে-সময় সেনা ছাউনিতে তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। সে-সময়ই তাঁর হাত এসে পৌঁছেছিল চিঠিটা। মুহূর্তে ঝলমল করে উঠেছিল তাঁর চোখ। সপ্তাহ দুয়েক আগেই নাকি ভূমিষ্ঠ হয়েছে তাঁর কন্যাসন্তান। অর্ধাঙ্গিনীকে এক দীর্ঘ চিঠি লেখার পরই, মেজরের কাছে দ্বারস্থ হয়েছিলেন ছুটির জন্য। আশাহত হতে হয়নি। ছুটি মিলেছিল একবাক্যে। তবে বাড়ি ফেরা অধরাই থেকে যায়। সদ্যোজাত সন্তানের মুখ আর দেখার আর সুযোগ হয়নি তাঁর।
আজ থেকে প্রায় ৮ দশক আগের কথা। বিশ্বযুদ্ধের (World War II) ময়দান থেকে এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিলেন মার্কিন ফাইটার পাইলট শ্যানন এস্টিল (Shanon Estill)। ছুটি পাওয়ার আগে, শেষ বারের জন্যও পি৩৮জে লাইটনিং ফাইটারে চেপে নাৎসি জার্মানিতে আঘাত হানতে উড়ান দিয়েছিলেন তিনি। তারপর ঠিক কী হয়েছিল, তা জানতে পারেননি কেউ-ই। পাওয়া যায়নি বিমানের ধ্বংসাবশেষ। এমনকি জার্মানদের হাতে বন্দি হওয়া সৈনিকদের তালিকাতেও ছিল না তাঁর নাম। এবার সেই রহস্যময় অধ্যায়ের সমাধান করলেন তাঁরই কন্যা শ্যারন এস্টিল টেলর। ইতিহাসের জট ছাড়িয়ে খুঁজে বার করলেন বিশ্বযুদ্ধের ময়দান থেকে ‘নিরুদ্দেশ’ হওয়া বাবাকে।
শৈশব থেকেই শ্যারন শুনে এসেছেন, একদিন না একদিন বাড়ি ফিরবেন তাঁর বাবা। দেশের সেনাবাহিনী, গোয়েন্দারা সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ব্যাপারে। আরেকটু বড়ো হতে শ্যারন বোঝেন, আদতে এ-সবই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি। কারণ সত্তর দশকের গোড়াতেই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করে মার্কিন সরকার। আসলে, যুদ্ধ শেষের পর মৃত কিংবা নিখোঁজ সৈনিকদের কি সত্যিই গুরুত্ব থাকে আর? তাই ইতিহাসের জট ছাড়াতে নিজেই এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন, তাঁর বাবা-মায়ের লেখা চার শতাধিক চিঠি।
হ্যাঁ, এক যুগ আগে লেখা সে-সময় চিঠির দৌলতেই ইতিহাসের এই রহস্যময় অধ্যায়ের জট ছাড়ান শ্যারন। প্রাথমিকভাবে সে-সকল চিঠিতে ব্যবহৃত প্রাচীন ডাক টিকিটের তদন্ত দিয়েই শুরু হয়েছিল শ্যারনের এই লড়াই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাবড় ডাক টিকিট সংগ্রাহকদের থেকে তিনি অনুসন্ধান করেছিলেন কবে এবং ইউরোপের কোন কোন অঞ্চলে ব্যবহৃত হত সে-সকল ডাকটিকিট। তারপর সামরিক ইতিহাসবিদের কাছে দ্বারস্থ হয়েছিলেন শ্যারন। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে অবস্থিত তৎকালীন মার্কিন সেনা-ছাউনিগুলিকে চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই খোঁজ মিলেছিল ১৯৪৫ সালে ১৩ এপ্রিল শেষবারের জন্য উড়ান নিয়েছিলেন তাঁর বাবা। শুধু তিনিই নন, সবমিলিয়ে সে-দিন পূর্ব জার্মানির শহর এলস্নিগের দিকে উড়েছিল ১০টি বিমান। তবে ফিরেছিল কেবলমাত্র ৭টি বিমান। বাকি ৩টি বিমান জার্মান হানার শিকার হয়েছিল বলেই অভিমত পোষণ করেন শ্যাননের সহকর্মীরা। তবে বিমানগুলির কোনো ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০০৩ সালে বড়ো সাফল্য পান শ্যারন। জার্মান ইতিহাসবিদ হ্যান্স-গুয়েন্থার প্লোসের লেখা থেকে জানতে পারেন এপ্রিল মাসে ৩টি মার্কিন বিমান ভেঙে পড়েছিল এলস্নিগে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেই দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন শ্যারন। জার্মান সরকার এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের সঙ্গে জোট বেঁধে উদ্ধার করেন বিমান এবং মানবদেহের অবশিষ্টাংশ। পরবর্তীতে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় শ্যাননের দেহাবশেষ।
২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছিল শ্যাননের দেহাবশেষ। যথাযথ সম্মান দিয়েই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁকে। পরবর্তীতে এই তদন্ত ও হারিয়ে যাওয়া বাবার স্মৃতিতে আস্ত একটি গ্রন্থও রচনা করেন শ্যারন। ‘ফ্যান্টম ফাদার— এ ডটারস কোয়েস্ট ফর এলিজি’-খ্যাত সেই গ্রন্থ রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল ২০১৬ সালে। তবে এই গল্প শুধুই শ্যানন এস্টিলের গল্প নয়। এখনও ‘খাতায় কলমে’ নিরুদ্দেশ বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ৭৩ হাজার মার্কিন সেনা। তাঁদের অনুসন্ধানেও আগামীতে লড়াই চালিয়ে যাবেন বলেই জানাচ্ছেন ৭৮ বছর বয়সি শ্যারন…
Powered by Froala Editor