আত্মীয়রা কথায় কথায় গালমন্দ করতেন হরানন্দ ভট্টাচার্যকে। প্রতিবেশীরা ঠাট্টা করতেন, অনেকে ব্যঙ্গ করে বলতেন ‘সাহেব’। কারণ? স্ত্রীকে প্রত্যেকদিন নিয়ম করে পড়াশোনা করাতেন তিনি। অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে পড়তেন গোলকমণি। হরানন্দ না থাকলে চেষ্টা করতেন একা একাই। মাঝেমধ্যে সাহায্য নিতেন পাড়ার ছেলেদের। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের লোক রুষ্ট। কলকাতাতেই তখনও স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে সবার চোখ খোলেনি, আর সেখানে চব্বিশ পরগনার মজিলপুর গ্রামের লোকজনের অবস্থা তো সহজেই বোঝা যায়। অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না হরানন্দ। বিদ্যাসাগর ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। তাঁদের সান্নিধ্যেই বুঝতে পেরেছেন স্ত্রীশিক্ষার প্রকৃত গুরুত্ব। সেবার গ্রামের একটি বালিকা বিদ্যালয়কে নিয়ে বিরক্ত হন জমিদারমশাই। ফতোয়া দিলেন যে, স্কুলে মেয়ে পাঠালে সেই পরিবারকে একঘরে করা হবে। হরনাথ ভট্টাচার্যও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। কেউ রাজি না হওয়ায় নিজের দুই মেয়েকে পাঠালেন স্কুলে। ফের চালু হল স্কুল।
কিন্তু কে এই হরনাথ ভট্টাচার্য? বাঙালির ইতিহাসে নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না তাঁর। বরং যদি বলা যায় তিনি শিবনাথ শাস্ত্রীর (Sivanath Shastri) পিতা, তাহলে বোঝা যেতে পারে সন্তানের আজীবনের সাধনা কোথা থেকে এসেছিল। অবশ্য ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করা নিয়ে দুজনের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়েছিল পরবর্তীকালে। কিন্তু, সেসব আপাতত আলোচ্য নয়। আসল কথাটা হল, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্ত্রীশিক্ষার পরিস্থিতি একবার খতিয়ে দেখা। ‘নাটুকে’ রামনারায়ণ তর্করত্ন প্রায়ই বলে বেরোতেন, “বাপরে বাপ মেয়েছেলেকে লেখাপড়া শেখালে কি আর রক্ষা আছে?” মদনমোহন তাঁর দুই মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর পর পণ্ডিতরা নিজেদের মধ্যে দেখা হলেই রসিকতা করত, “ওরে মদনা করলে কি? ওরে মদনা করলে কি?” সমাজচ্যুত করা হয় তাঁকে। গোবিন্দ্রচন্দ্র গুপ্তের মেয়ে ও ভাগ্নি স্কুলে পড়ায় বিয়ের সম্বন্ধ ভেস্তে যায় তাদের। মহিলারা লেখাপড়া শিখলে বিধবা হবে, সংসার করবে না, স্বভাবচরিত্র খারাপ হবে। এই তো ছিল লোকচলতি কথাবার্তা।
তার মধ্যেও যাঁরা সেদিন সর্বস্ব পণ করে লড়ে গেছিলেন, শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁদের মধ্যে একজন। মামা দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকার সম্পাদক। বিদ্যাসাগর ছিলেন শিবনাথের আদর্শ। নিজেকে ‘বিদ্যাসাগরের চেলা’ বলতেও আপত্তি ছিল না কোনো। ১৮৬৯ সালে কেশবচন্দ্র সেনের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। ১৮৭২-তে এম এ পাশ করে ‘শাস্ত্রী’ উপাধি লাভ করেন শিবনাথ। সে বছরই যুক্ত হয়ে পড়েন কেশবচন্দ্রের ভারত আশ্রমের মহিলা বিদ্যালয়ের কাজকর্মে। যদিও কেশবচন্দ্রের নারীশিক্ষার দৃষ্টিভঙ্গিতেও অনেক সংকীর্ণতা ছিল। শিবনাথ জ্যামিতি, লজিক, মেটাফিজিক্স পড়াতে চাইলে তিনি তো বলেই দিলেন, “এ সকল পড়াইয়া কি হইবে? মেয়েরা আবার জ্যামিতি পড়িয়া কি করিবে?” কিছুটা অসন্তুষ্ট হলেও নতুন বুদ্ধি আবিষ্কার করলেন শিবনাথ। মুখে মুখে বলে গেলেন ‘মেন্টাল সায়েন্স’-এর তত্ত্ব, লিখে রাখলেন ছাত্রীরা। পরে সেই ‘নোট’-ই পরিমার্জন করে ছেপে দিলেন ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকায়। কিছুদিনের মধ্যেই আদি ব্রাহ্মসমাজের লোকেদের সঙ্গে স্ত্রী-স্বাধীনতা বিষয়ে শিবনাথের মতবিরোধ বাড়তে থাকেন। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৪ করা নিয়ে যখন তাঁরা আন্দোলন করছেন, তখন দেখেন কেশবচন্দ্র নিজের নাবালিকা মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে তুলে দিলেন। তাঁদের সঙ্গ ত্যাগ করলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, ১৮৭৮ সালে গড়ে তুললেন ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ'।
আরেকটা স্বপ্ন ছিল ‘ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়’-কে নিয়ে। তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত স্কুলটি যুক্ত হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। পরে অবশ্য সিটি স্কুল-সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তৈরিতে প্রধান ভূমিকা নেন তিনি। স্ত্রীশিক্ষা না হলে সমাজ খোঁড়া হয়ে যাবে, সে কথাটা পরবর্তীকালেও বহু সভাসমিতিতে বলেছেন। বিশ শতকের শুরুর দিকে সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছিল ঠিকই, কিন্তু তা আদৌ পর্যাপ্ত কিনা, এ প্রশ্ন তিনি বারবার তুলেছেন, “এ সকল উন্নতির চিহ্ন তাহাতে সন্দেহ কি? কিন্তু বিগত সেন্সাস রিপোর্টে দেখিতেছি, এ সকল সংগ্রহ করিয়াও লিখিতে ও পড়িতে পারেন এরূপ স্ত্রীলোকের সংখ্যা এই বঙ্গদেশে হাজারের মধ্যে ৫ জনের অধিক হয় নাই।”
আরও পড়ুন
বন্ধুর অহংকার ভাঙাতেই প্রথম কবিতা লেখেন শিবনাথ শাস্ত্রী
তাতে কি লড়াই বন্ধ থেকেছে? না, বরং ঘর থেকেই শুরু হয়েছিল শিক্ষাদানের যজ্ঞ। প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত না হলেও জাতীয়তাবাদী কাজকর্মের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। একবার বিপিনচন্দ্র পাল গেছেন তাঁর বাড়িতে, সেটাই প্রথমবার। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, একটি নয়-দশ বছরের মেয়ে নিঃসংকোচে দরজা খুলে একদল অপরিচিত যুবককে অভ্যর্থনা জানাল। মেয়ের মধ্যে দিয়ে গৃহস্বামীর চরিত্রের পরিচয় পেলেন তিনি। বিধবাবিবাহ প্রচলনের সঙ্গেও শিবনাথ শাস্ত্রী জড়িয়ে ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে। যৌবনে একবার ঘটকালি পর্যন্ত করে দিয়েছিলেন এক বিধবা যুবতীর। নবদম্পতিকে সমাজ গ্রহণ না করায়, নিজের স্কলারশিপের টাকায় সংসার চালাতেন তাদের।
আরও পড়ুন
বিশ্বভারতী এবং একটি পাঁচিল: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষারীতির ভিতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছে কি?
সামাজিক আন্দোলন হোক কিংবা ব্রাহ্ম সমাজের আভ্যন্তরীণ ধর্মীয় গতিবিধি, সব জায়গাতেই বলিষ্ঠ অবদান ছিল তাঁর। ‘আত্মচরিত’, বিলেত ভ্রমণের বর্ণনা, উপন্যাস, কবিতা এসবও রয়েছে সৃষ্টিতালিকায়। প্রকাশ করেছেন শিশুদের পত্রিকা ‘মুকুল’। ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’-এ মেলে তাঁর ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে শুধুমাত্র একটি মাত্র মাপকাঠিতে শিবনাথ শাস্ত্রীকে বিচার করা অসম্ভব একটি কর্ম। উনিশ শতকের এক বিরাট পরিবর্তনের আদর্শকে তিনি ধারণ করেছিলেন নিজের মধ্যে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যে সঠিক পথেই ছিল, সেটা কিন্তু বারবার প্রমাণিত হয়েছে পরবর্তী সময়ে।
ঋণস্বীকার :
আত্মচরিত, শিবনাথ শাস্ত্রী
শিবনাথ শাস্ত্রী সংখ্যা, পশ্চিমবঙ্গ
Powered by Froala Editor