লোহার খাঁচার ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড এক গোলক। ব্যাস অন্ততপক্ষে চার মিটার। আদতে এই গোলক যে একটি গ্লোব, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে এই গ্লোব ভূগোলের ছাত্রদের জন্য তৈরি নয়। রঙিন তুলির টানা তার ওপর পৃথিবীর সুন্দরতম মানচিত্র শোভা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই গ্লোবের গা-জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ফাটল। রেজিন এবং ফাইবারের প্লেট দিয়ে এই গ্লোব তৈরি হওয়ার জন্যই এইসকল শূন্যস্থানের জন্ম।
পৃথিবীর এই দৈত্যাকার মিনিয়েচারটি তৈরি করেছেন জেরুজালেমের শিল্পী (Artist) বেভারলি বরকত (Beverly Barkat)। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় অন্য একটি জায়গায়। যিনি এত যত্ন নিয়ে এমন একটি শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন, সেই শিল্পীরই চোখ এড়িয়ে গেল গ্লোবের (Globe) এই ফাটলগুলি? সেগুলি বুজিয়ে ফেলার কোনো উপায়ই কি ছিল না তাঁর কাছে?
ফাটলের গায়ে চোখ রাখলেই মিলবে এই প্রশ্নের উত্তর। সেখানে চোখ রাখলে খানিকটা অবাকও হতে হবে দর্শককে। আদ্যন্ত সুন্দর এমন একটি শিল্পকর্মের ভেতরটা যে গা ঘিন ঘিনে। গ্লোবের ভেতরে অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে প্লাস্টিকের বর্জ্য, পলি ব্যাগ। যে ফাইবারের প্লেট দিয়ে তৈরি গ্লোবের উপরিতল, তার ভিতরের গা থেকেও খোঁচা খোঁচা হয়ে বেরিয়ে রয়েছে অজস্র প্লাস্টিকের টুকরো। না, অপরিকল্পিত নয়। ইচ্ছাকৃতভাবেই গ্লোবের গায়ে শূন্যস্থানগুলিকে জায়গা দিয়েছেন বেভারলি। দর্শকদের কঠিন বাস্তবকে চাক্ষুষ করানোর জন্য।
বেভারলির অভিমত, পৌরাণিক কাহিনিতে স্বর্গরাজ্য থাকলেও বাস্তবে আলাদা করে তার অস্তিত্ব নেই। বরং, এই পৃথিবী স্বয়ং একটি স্বর্গরাজ্য। আর দূষণের জেরে ক্রমশ তা পরিণত হচ্ছে নরকে। সমুদ্রের তলদেশ থেকে শুরু করে হিমালয় এমনকি ভূগর্ভেও ছড়িয়ে পড়েছে প্লাস্টিক দূষণ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাণীজগৎ। প্লাস্টিকের এই বাড়বাড়ন্তে একটা সময় আটকা পড়বে মানব সভ্যতাও, এমনটাই মনে করেন বেভারলি। তাই মানুষকে সচেতন করতেই এমন অভিনব উদ্যোগ তাঁর। শিল্পের মধ্যে দিয়েই কঠিনতম সেই বাস্তবকে তুলে ধরতে চাইছেন তিনি। সেইসঙ্গে সামান্য ক্ষমতা নিয়ে নিজের মতো করেই প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।
আরও পড়ুন
আঙুল হারানোর যন্ত্রণাকে ভাস্কর্যে ধরে রাখছেন মার্কিন শিল্পী
হ্যাঁ, গোটা গ্লোবটাই তৈরি হয়েছে প্লাস্টিকের বর্জ্য দিয়ে। যাকে প্রথম থেকে ফাইবার ভেবে আসছেন, আদতে তা তৈরি প্লাস্টিকের প্রক্রিয়াকরণে। রেজিনের মধ্যে পরিবেশ থেকে সংগৃহীত ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল, পলি ব্যাগ, মাছ ধরার জাল ইত্যাদি মিশিয়ে নিজেই এই ফাইবার তৈরি করেছেন বেভারলি। আর তা দিয়েই সাজিয়ে তুলেছেন ‘আর্থ পোয়েটিকা’-খ্যাত এই গ্লোব।
আরও পড়ুন
পক্ষাঘাতে হারিয়েছে চলচ্ছক্তি, মুখ দিয়েই ছবি আঁকেন বাংলাদেশের শিল্পী
৯/১১-এর ধাক্কা কাটিয়ে ২০১৪ সালে নতুন করে খুলে যায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দরজা। নবনির্মিত এই ভবনকে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব পড়েছিল বেভারলির কাঁধে। মানুষকে সচেতন করতে সেই সময় থেকেই প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারে জোর দেন তিনি। শিল্পের পাশাপাশি এর জন্য তাঁকে রসায়ন নিয়ে চর্চা করতে হয়েছে বেশ খানিকটা। ট্রেড সেন্টারের দ্বিতীয় টাওয়ারের নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ হয়নি এখনও। সেখানেই জায়গা পেতে চলেছে বেভারলির নির্মিত ‘আর্থ পোয়েটিকা’-খ্যাত দৈত্যাকার গ্লোব। এমন একটি জায়গায় তাঁর তৈরি শিল্পকর্ম উচ্চপদস্থ এবং ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্বদের নজর কাড়বে, তা নিশ্চিত। তাঁদের দশ জনের মধ্যে একজনও যদি দূষণ নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন, তবে স্বার্থক হবে এই শিল্পের সৃষ্টি। এমনটাই মনে করছেন জেরুজালেমের ৫৫ বছর বয়সী বেভারলি…
আরও পড়ুন
শিল্পীদের তুলিতে পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রদর্শনী মার্কিন রেস্তোরাঁয়
Powered by Froala Editor