প্যারিস— প্রেমের শহর, মুগ্ধতার শহর, আলোর শহর। যার সবথেকে বড়ো আকর্ষণ আইফেল টাওয়ার (Eiffel Tower)। রাতের আঁধারকে ম্লান করে দিয়ে মোহময়ী আলোর ধারা বইছে সর্বাঙ্গ জুড়ে। সারা বিশ্বের মানুষ ছুটে আসে সৌন্দর্যের মাদকতায়। প্রতি বছর নববর্ষে ও বাস্তিল দিবসে সাজিয়ে তোলা হয় নিত্যনতুন রূপে। যদিও তার সূত্রপাত হয়েছিল এক বাঙালির হাত ধরে। থিয়েটারমহল তাঁকে চেনে ‘আলোর জাদুকর’ নামে। প্রকৃত নাম তাপস সেন (Tapas Sen)। ইতিহাসের এক মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁরই চেতনার রঙে নির্মিত হয়েছিল আইফেল টাওয়ারের চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা।
তখন সকলেই প্রতীক্ষায় নতুন সহস্রাব্দের। অর্থাৎ বিশ শতক পার করে পৃথিবীবাসী পা রাখবে একবিংশ শতকে। তোড়জোড় শুরু হয়েছে ফ্রান্সেও। আইফেল টাওয়ার শুধু সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, এক অর্থে দেশের প্রতিনিধিও বটে। হাজার ফুটের থেকেও বেশি উচ্চতাসম্পন্ন টাওয়ারটি প্যারিসের সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্য নিদর্শন। পুরনো বছরের প্রহর শেষে তাকে সাজিয়ে তুলতে হবে রাঙা আলোয়। সারা বিশ্বের সেরা আলোকশিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হল এই কাজের জন্য। সেই তালিকায় ছিলেন তাপস সেনও। টাওয়ারের উপরের ভাগের আলোকসজ্জার দায়িত্ব পেলেন তিনি। অবশেষে এল ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। বারোটা বাজতে ঠিক তিন মিনিট বাকি। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে জ্বলে উঠতে শুরু করল আইফেল টাওয়ার। উপরিভাগে পৌঁছে নীল আলোয় তৈরি হল এক মায়াময়ী রূপ। বারোটার সময় আলোচ্ছটায় যেন প্রায় ঝলসে গেল রাতের আকাশ। আলোয় ভরে উঠল গোটা শহর। শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে স্থাপত্যটি শত প্রদীপের শিখায় যেন পথ দেখাচ্ছে তাদের। যার পুরোটাই ছিল তাপস সেনের পরিকল্পনা।
তবে তাঁর যাত্রা শুরু অনেক আগে। প্রায় চারের দশক থেকে। সেই সময় বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে চলছে এক পালাবদল। সেই সময়ে গুরু প্রতাপ সেনের কাছে দিল্লিতে কাজ শিখছিলেন নিজের মতো করে। সেখানেই বনফুলের ‘বিদ্যাসাগর’ নাটকে প্রথম আলোর দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন পর পারিবারিক তাড়নায় কাজের খোঁজে পাড়ি দিলেন মুম্বই। অবশেষে ১৯৪৮-এ ফিরে এলেন কলকাতায়। কাজ করলেন পেশাদার থিয়েটারগুলিতেও। তবে মন ভরল না। তখন একদিকে গণনাট্য সংঘ, উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার গ্রুপ, অন্যদিকে শম্ভু মিত্রের বহুরূপী—বাংলা অপেশাদার থিয়েটারে চাঁদের হাট। আর তাপস সেন ঢুকে পড়লেন সবখানেই। কলকাতায় প্রথম আলোকসম্পাতের দায়িত্ব পেলেন ঋত্বিক ঘটকের নাটক ‘জ্বালা’-য়।
১৯৫৪ সালে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় ‘বহুরূপী’ প্রযোজনা করে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটক। নাটকের মান যেমন উচ্চস্তরের, পুঁজিতেও ঠিক ততটাই টান। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই, আলোকশিল্পী তাপস সেনের কাছে মজুত সমস্ত সমস্যার সমাধান। ডালদার টিনের সাহায্যে তৈরি করলেন এক অপূর্ব মঞ্চমায়া। পৌষের পাকা ধানের আমেজের হলুদ আলো যে কখন নন্দিনীর আগমনে সিঁদুরে মেঘে পরিণত হয়, ধরতে পারেন না কেউই। ছায়ায় আঁকা হয় ‘সিলুয়েড’ নন্দিনীর দেহ। রাজার এঁটোর দৃশ্যে দূর থেকে এসে পড়ে একফালি ফ্যাকাশে আলো। এক প্যাটার্ন থেকে অন্য প্যাটার্নে অনরবত ঘুরতে থাকে ‘ডিমার’। স্বয়ং তাপস সেনের ভাষায় এই আলোকপদ্ধতির নাম ‘ইকিড়-মিকিড়’। তাঁর আলো যেন কথা বলে উঠল মনস্ত্বত্ত্বের ইশারায়। যোগ্য সঙ্গ দেন মঞ্চশিল্পী খালেদ চৌধুরীও।
আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির শখের থিয়েটার ও জোড়াসাঁকো নাট্যশালা
কয়েক বছর পরে বিশ্বরূপার পেশাদার মঞ্চে পালন করছেন ‘সেতু’ নাটকের আলোর দায়িত্ব। একটি বিশেষ মুহূর্তে নায়িকা শোভা সেনের মুখে দূর থেকে পড়তে থাকে ট্রেনের আলো। ক্রমে বাড়তে থাকে তার তীব্রতা। শুধু আলোর জাদুতে যেন মঞ্চের উপর দিয়ে ঝড়ের মতো বয়ে গেল একটা আস্ত ট্রেন। নির্বাক হয়ে যান উপস্থিত সমস্ত দর্শক। যদিও এই নিয়ে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। অনেকের মতে, আলোকসম্পাতে আঙ্গিকের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে গৌণ হয়ে গেছিল অভিনেত্রীর অভিব্যক্তি। একই রকম বক্তব্য উঠে এসেছিল উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’ নাটকের সময়ও। নাটকের শেষ দিকে কয়লাখনির গভীরে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে শ্রমিকদল। এই বুঝি জলের তোড় ভাসিয়ে নিয়ে যায় তাদের। সেই স্রোত এল তাপস সেনের আলোক পরিকল্পনায়। নীল আলোর আশ্চর্য সম্পাদনায় জলস্তর বাড়তে লাগল খনির ভিতরে। সঙ্গে চলছে শ্রমিকদের তীব্র আর্তনাদ। এক্ষেত্রেও বিতর্ক ছিল যে, ম্লান হয়ে গেছিল শ্রমিকদের মৃত্যুর বিভীষিকা। আলোচনা হয়েছিল শুধুমাত্র আলোর চমৎকারিত্ব নিয়ে।
আরও পড়ুন
আইফেল টাওয়ার পছন্দ নয়, প্যারিস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মঁপাসা
অবশ্য এসব বিতর্কে কোনোদিনই মাথা ঘামাননি তিনি। ১৯৬৫ সালের কথা। ইতিহাস বিকৃতির দায়ে মিনার্ভায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’ নাটক। প্রায়ই দুষ্কৃতির আক্রমণে পণ্ড হয়ে যায় অভিনয়। গ্রেপ্তার হলেন উৎপল দত্ত। সারা বাংলা জুড়ে উঠল প্রতিবাদের ঝড়। অন্যতম নেতৃত্বে তাপস সেন। মুখে মুখে ফিরতে লাগল তাঁর স্লোগান, “কল্লোল চলছে, চলবে।” জনতা সেদিন পাহারা দিয়েছিল মিনার্ভা থিয়েটার, হাউসফুল হয়েছিল প্রতিটি শো। শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হয় তৎকালীন কংগ্রেস সরকার।
‘চলছে, চলবে’—এটা আসলে তাপস সেনের জীবনেরও স্লোগান। মঞ্চের নেপথ্যে তাঁর জীবন। ‘রক্তকরবী’, ‘সেতু’ কিংবা ‘অঙ্গার’ তো নিছক উদাহরণ মাত্র। আরো অসংখ্য নাটক-সিনেমার তিনি নেপথ্য শিল্পী। তাঁর জন্ম ১৯২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, আসামের ধুবুড়িতে, মৃত্যু ২০০৬। সে অর্থে এবছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। কিন্তু তাতেও কি পাদপ্রদীপের আলোয় দেখা যাচ্ছে তাপস সেনকে? অমিতাভ বচ্চন আইফেল টাওয়ার দেখে ব্লগ লিখেছিলেন তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। প্যারিসকে আলো দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বাঙালির কাছে কি নেপথ্যেই রয়ে গেল তাঁর নাম? উত্তর হবে— না। তিনি আছেন মঞ্চের জাদু আর বিজ্ঞানের ‘অন্তরঙ্গ আলো’-তে। তিনি আছেন যেখানে থাকার কথা, সেখানেই—‘ধূসর প্রসর রাজপথে, জনতার মাঝখানে’।
Powered by Froala Editor