একদিকে দমদমে তৈরি হচ্ছে তাঁর নামে স্টেডিয়াম, আর অন্যদিকে বাগুইহাটিতে ভাঙা পড়ছে তাঁর বাসগৃহ। যেন স্মৃতি-বিস্মৃতির খেলার সাক্ষী মার্চ মাসের কলকাতা। আর সেই খেলার নেপথ্যনায়কের ভূমিকায় অমল দত্ত।
আরও পড়ুন
ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে গ্যারাজ! প্রতিবাদে সরব দু’বাংলাই
কলকাতা তো বটেই, ভারতবর্ষের ফুটবল ইতিহাসের মনুমেন্ট তিনি। তাঁর বাগুইহাটির বাসগৃহ স্থানীয়দের কাছে যেন একটা ল্যান্ডমার্ক। অটোরিকশা তো বটেই, এমনকি বাস অবধি দাঁড়িয়ে যেত তাঁর বাড়ির সামনে। এখনও যায়। ২০১৬ সালে প্রয়াত হন ৮৬ বছরের কিংবদন্তি অমল দত্ত। তারপরেও এতদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর নামের ফলক আঁটা দোতলা বাড়িটা। ছিল। আজ আর নেই। কারণ তাঁর বাড়ি সম্প্রতি বিক্রি হয়ে গিয়েছে এক অবাঙালি প্রোমোটারের হাতে। আর এখন সেখানে পড়ে আছে একটা ভগ্নস্তূপ। দোতলা বাড়ির দোতলা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ভেঙে পড়েছে গেটের একদিকের পাল্লা। গেটের পাশে শ্বেতপাথরের ফলকটাও নেই। নেই বাড়ির সামনে কৃষ্ণের ছবিটা। শুধু থেকে গেছে সেই বাড়িকে ঘিরে স্থানীয় মানুষদের নস্টালজিয়া।
আরও পড়ুন
মাড়োয়ারির কাছে বিক্রি হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি, অভিমানে আর ফিরলেন না অবনীন্দ্রনাথ
মাঝমাঠ ফাঁকা করে হঠাৎ সরে যাচ্ছেন মোহনবাগানের খেলোয়াড়রা। বিপক্ষ দল এগিয়ে আসছে গোলপোস্টের দিকে। তারপরেই হঠাৎ ঝটিকা আক্রমণ। খেলার পরিভাষায় এই কৌশলের নাম 'ডায়মন্ড সিস্টেম'। আর কলকাতার মাঠে এই সিস্টেমের প্রবক্তা অমল দত্ত। অনেকের কাছেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন 'ডায়মন্ড' দত্ত নামে। এমনকি সাইডব্যাক প্লেয়ারদেরও আক্রমণের অংশ করে নিয়েছিলেন তিনি। খেলার মাঠের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক আর ঘরোয়া পরিবেশে সকলের প্রিয় দাদা। তাঁর বাড়িতে আড্ডা জমাতে আসেননি এমন মানুষ কলকাতার ফুটবল জগতে পাওয়া দুষ্কর। পি কে ব্যানার্জি, সুব্রত ভট্টাচার্য যেমন এসেছেন, তেমনই এসেছেন খেলার মাঠের ছাত্র সত্যজিৎ চ্যাটার্জি, কৃশানু দে সহ সত্তর, আশি, নব্বইয়ের দশকের দাপুটে ফুটবলাররা। এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের ফুটবলার মেহতাব হোসেনও এই বাড়িতে সন্ধে কাটিয়ে গিয়েছেন। তবে সেই সবকিছুই এখন বিস্মৃত অতীত। বাড়িটাই যে আর নেই। ভাঙা মন্দিরের মতো দাঁড়িয়ে আছে সাড়ে তিনখান দেয়াল। সেটুকুও আর থাকবে না কিছুদিন পর। হয়তো সেখানে তৈরি হবে কোনো বহুতল আবাসন। অমল দত্তের বাড়ির ঠিকানা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও।
আরও পড়ুন
দেশভাগ-পরবর্তী বাংলার প্রথম ভাষাসৈনিক তিনি, জরাজীর্ণ অবস্থায় ধুঁকছে তাঁর বাড়িই
অমল দত্ত মারা গেছেন ২০১৬ সালে। তার কিছুদিনের মধ্যেই চলে গেছেন স্ত্রী আরতি দেবীও। বাগুইহাটির কিছু দূরেই থাকেন তাঁর ছেলে। তবে বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলতে চাননি তিনি। স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, রাস্তা উঁচু হওয়ায় বাড়িতে জল ঢুকতো বলেই বাড়ি বিক্রি করেছেন তিনি। কেউ কেউ আবার বলছেন, সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে জটিলতার কারণেই এই সিদ্ধান্ত। তবে অমল দত্তের বাড়ি ভেঙে পড়ায় দুঃখিত প্রতিবেশীরা প্রত্যেকেই। স্থানীয় এক ব্যক্তির কথায়, ‘অমল দত্তের বাড়ির কাছে থাকি, এটা একটা গর্ব ছিল। সেই গর্বটাই আর থাকল না।’ অনেকে বলেন, বাঙালি ইতিহাসে বাঁচে। অথচ ইতিহাস মুছে ফেলতেও বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। গর্বের অনেককিছুই হেলায় নষ্ট করে ফেলতে অভ্যস্ত আমরা। অথচ একটু চেষ্টা করলেই কি এইসব স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না? এখন তো আর সেই সুযোগও নেই।