১৭৯৩ সালের এক সন্ধ্যায় ‘প্রিন্সেস মারিয়া’ জাহাজ থেকে কলকাতার চাঁদপাল ঘাটে নামলেন এক সাহেব। আপাতত উদ্দেশ্য, ভারতে ব্যাপিস্ট মিশনের হয়ে খ্রিস্ট ধর্মপ্রচার। একদিন নদীপথে ফেরার সময় তিনি উদ্ধার করেন মৃত্যুপথযাত্রী এক নারীকে। অসহায়া মেয়েটিকে দত্তক নিয়ে পিতৃস্নেহের ছায়া দিলেন। তাঁর নাম উইলিয়াম কেরি। বাংলা সাহিত্যে গদ্যরীতির আবির্ভাবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে যাঁর নাম।
কেরি সাহেবের জীবনের প্রসঙ্গে উঠে আসে এরকম অসংখ্য গল্পকথা। প্রমথনাথ বিশীর ‘কেরিসাহেবের মুন্সি’ উপন্যাসে আছে এরকমই এক কাহিনি। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে এলেও মিশনারিদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল খোদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তারা ব্যবসায়ী—ধর্মের উন্মাদনা তাদের কাছে বালাই বিশেষ। সেই কারণে কেরি সাহেবকে ঠাঁই নিতে হল ডেনমার্কের উপনিবেশ শ্রীরামপুরে। এখানে তাঁর সঙ্গী জোশুয়া মার্শম্যান ও উইলিয়াম ওয়ার্ড। এই ‘শ্রীরামপুর ত্রয়ী’ মিলে বাংলার গ্রামে-গ্রামে ঘুরে বেড়ালেন খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে।
একদিন নদীবক্ষে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল তাঁর। গভীর রাতে নৌকায় থাকাকালীন শুনলেন এক নারীর বাঁচার তীব্র আর্তনাদ। সঙ্গী রামরাম বসুর থেকে ‘সহমরণ’ বিষয়টি জেনে উদ্ধার করলেন মেয়েটিকে। তার নাম রেশমি। স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটিকে আর সমাজ গ্রহণ করল না। কেরি সাহেবের সান্নিধ্যে শুরু হল তার পথচলা। আরেকটি মত অনুযায়ী এক মুসলিম নারীকে পতুর্গিজ দস্যুদের হিংস্র খপ্পর থেকে উদ্ধার করেন তিনি। পরে এক মুসলিম যুবকের সঙ্গে বিয়েও দেন। মেয়েটির নাম ছিল জিন্নাত বিবি। তার নামে আজও বরিশালে রয়েছে ‘বিবির পুকুর’।
এসব নেহাতই গল্পকথা। কিন্তু বাংলা গদ্যরীতি ও ছাপাখানার জগতে উইলিয়াম কেরির ভূমিকা কোনো প্রচলিত কাহিনি নয়। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি কাজ করতেন জুতোর দোকানে। তখনই শিখেছিলেন ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, হিব্রু আর গ্রিক ভাষা। ভারতে এসে কিছুদিন এদিক-ওদিক ভেসে বেড়ালেন। কাজ করলেন নীলকুঠিতেও। একই সঙ্গে কেরিসাহেব সংগ্রহ করে চলছিলেন গ্রাম-বাংলার মানুষের মুখের ভাষা। অবশেষে ১৮০০ সালের শ্রীরামপুরে মিশন প্রতিষ্ঠা করে তিনি শুরু করলেন ছাপাখানার কাজ। প্রধান উদ্দেশ্য অবশ্য ধর্মপুস্তক প্রকাশ।
আরও পড়ুন
কলকাতায় বসেই ছাপাখানার নতুনত্বে সারা পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর
বাঙালি তখনো গদ্যে সাহিত্যরচনা করে না। কেরিসাহেবের মিশন থেকে শুরু হল গদ্যে বাইবেলের অনুবাদ। পরের বছর প্রকাশিত হল কেরির প্রথম গদ্যগ্রন্থ ‘কথোপকথন’। কেরি সাহেব গ্রামভ্রমণের অভিজ্ঞতা ঢেলে দিলেন এই গ্রন্থে। যদিও অনেকের মতে এই গ্রন্থে রামরাম বসুর সাহায্যের ছাপ অত্যন্ত স্পষ্ট। ১৮১২-তে বেরোল ‘ইতিহাসমালা’। যা বাংলার প্রথম দিকের গল্পগ্রন্থগুলির মধ্যে অন্যতম। ততদিনে রামমোহন রায়ও কলম ধরেছেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে ইংরেজ সাহেবদের বাংলা শেখার জন্য ধারাবাহিকভাবে বই প্রকাশিত হচ্ছে। রামরাম বসু, গোলকনাথ শর্মা, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার প্রমুখরা লিখে চলেছেন একের পর এক গ্রন্থ। শুরু হল বাংলা গদ্যের পথচলা।
আরও পড়ুন
সতীদাহ বন্ধ হোক, চায়নি সেকালের মিডিয়াও!
যার নেপথ্যে রয়েছে উইলিয়াম কেরির উদ্যোগ। পুত্রশোক, স্ত্রীবিয়োগের যন্ত্রণায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবন শান্তিপূর্ণ ছিল না। একবার শ্রীরামপুর মিশনের ছাপাখানায় আগুন লেগে ভস্মীভূত হয়ে গেছিল অসংখ্য বই। তা সত্ত্বেও থামেননি তিনি। ১৮৩৪ সালের ৯ জুন তাঁর মৃত্যু ঘটে। শ্রীরামপুরে তাঁর সমাধিক্ষেত্রটিতে আজও লেখা রয়েছে,
A wretched poor and helpless worm.
On thy kind arms I fall.
সত্যিই কি তিনি অসহায়ের মতো হারিয়ে গেছেন সময়ের অন্তরালে? বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উইলিয়াম কেরির নামাঙ্কিত একাধিক অ্যাকাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর এই বাংলায়? আমরা কি এইভাবেই হারিয়ে ফেললাম উইলিয়াম কেরিকে?
তথ্যঋণ :
কেরী সাহেবের মুন্সী, প্রমথনাথ বিশী
বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, পঞ্চম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor