একটি আত্মহত্যা। অবসাদে। আতঙ্কে।
টানা ৯৯ দিন ট্রেন বন্ধ থাকায় দোকানে ঝাঁপ পড়েছিল। বারাকপুর স্টেশন চত্বরেই ছিল দোকান। না ছিল দোকান খোলার আশু সম্ভাবনা; না, এই চক্রব্যূহ থেকে বেরোনোর উপায় জানা। অবসাদগ্রস্ত হয়ে সঞ্জয় পাশোয়ান নামে ওই ব্যক্তি দোকানের মধ্যেই আত্মহত্যা করেন।
এটুকুই সংবাদে প্রকাশ। কিন্তু সেই সংবাদ আমাদের ভিতর কোনও দীর্ঘস্থায়ী আলোড়ন তৈরি করতে পারেনি। এই না-করতে পারার পিছনে অবশ্যই আমাদের তন্ত্রীতে-তন্ত্রীতে বাসা বেঁধে থাকা অর্থনৈতিক শ্রেণী-বিভাজনের ভূত আছে। যা প্রায় সঙ্গোপনেই অত্যন্ত সুচারুভাবে আমাদের শিখিয়েছে, কোন মৃত্যু নিয়ে আমাদের উদ্বেল হতে হবে, আর কোনটি নিয়ে নয়। প্রসঙ্গত, সমসময়েই অবসাদ-জনিত কারণে (অন্তত এখনও পর্যন্ত সংবাদমাধ্যম সূত্রে যেমনটা জানা যাচ্ছে) জনৈক অভিনেতার মৃত্যু নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যে-আলোড়ন চলছে, তা কারোরই নজর এড়ানোর কথা নয়। সে-মৃত্যু যদি আমাদের শোকাচ্ছন্ন করতে পারে, অবসাদ নিয়ে, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাজ-না-পাওয়া নিয়ে যদি আলোচনার অভিমুখ ঘুরে যেতে পারে, তাহলে এই সঞ্জয় পাশোয়ানের মৃত্যু আমাদের ভাবিয়ে তুলল না কেন!
খেয়াল করলে দেখব, এই অতিমারীর গোড়া থেকে আমাদের ভাবানো হয়েছে, ঘরে-থাকাই এত বড়ো সমস্যাটার একমাত্র সমাধান। নানারকম মিডিয়া নানা কায়দায় সেই ধারণাটি সঞ্চারিত করেছে মনে-মনে। ঘরে-থাকার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার না করলেও, কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। জনগণের এই ঘরবন্দি থাকার সময়টুকুকে ঠিক যেভাবে কাজে লাগানোর কথা ছিল, যাতে সমাধানে না হোক, অন্তত সমাধানে কাছাকাছি পৌঁছনো যেত, তাতে আমরা পৌঁছাতে পেরেছি কি? সে-দায়িত্ব যাঁদের ছিল, তাঁরা যথাযথ ভূমিকা পালন করেছেন কি? এর উত্তরগুলো আমাদের জানা। কিন্তু তা স্বীকার করতে আমরা নানাভাবেই ভয় পাচ্ছি। যেমন, শ্রমিকদের দুরাবস্থা দেখে আমরা ব্যথিত হয়েছি, আর মেনে নিয়েছি যে, লকডাউন তো অবধারিত ছিল। তবু, এত কম সময়ের নোটিশে, কোনরকম বিকল্প ব্যবস্থা না-করে কেন সেই অবধারিত পদক্ষেপটি করা হল, সে-প্রশ্ন আমরা ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে করতে ভুলে গিয়েছি; কিন্তু ভারতবর্ষের ধুলোয় থেকে যাওয়া শ্রমিকদের বিক্ষত পদচিহ্ন সে-প্রশ্নকে মিলিয়ে যেতে দেয়নি। এই বয়ানেরই আর-একটি অনুচ্ছেদ সঞ্জয় পাশোয়ানের মৃত্যু।
ইতোমধ্যে লকডাউন থেকে আনলকে আমাদের বদলে গিয়েছে রিংটোন। মেনে নেওয়ার মানসিক-জমি। যে আমরা ভেবেছিলাম, গৃহবন্দি হওয়াই স্বদেশের প্রতি আমাদের এক ও একমাত্র কর্তব্য, সেই আমরাই ভাবতে শিখে গিয়েছি, যে, আর কতদিন! এবার ঘর থেকে বেরিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখাই আমাদের শিরোধার্য। কিন্তু যে কারণে ঘরে-থাকা, সেই কারণটির এতদিনে কী অবস্থা? অন্তত তথ্য যা বলছে, আর বাস্তবে যে পদক্ষেপ করা হচ্ছে, সে-দুয়ের কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ’-তেই বিশ্বাসী। ফলে, এই গরমিলের ব্যাপারে যাঁদের কৈফিয়ৎ দেওয়ার কথা, তাঁরা শুধু তা দিচ্ছেন না তাই-ই নয়, দেওয়ার তাগিদও অনুভব করছেন না। সঞ্জয় পাশোয়ান জানতেন এই বাস্তবকে। এই সত্যি-মিথ্যের হা-ডুডুর ভিতর সেই মানুষটির কী হবে, যার উপার্জনের রাস্তাটিকেই বন্ধ করে রেখে দেওয়া হয়েছে? উত্তর নেই। সঞ্জয়ের কাছেও কোনও উত্তর ছিল না।
ট্রেন বেসরকারিকরণের প্রস্তাব সামনে আসা-মাত্র জনসাধারণের মধ্যে আলোড়ন পড়েছিল, এই মর্মে যে, সাধারণ মানুষের স্বার্থ আর রক্ষিত হবে না। সে-চিন্তা অমূলক নয়। যে-দায়িত্ব সরকারের পালন করার কথা, তা যদি সরকার না করে, তবে মূল্য চোকাতে হয় সাধারণ মানুষকে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি আর বেসরকারি হাসপাতালগুলির ক্ষেত্রে এই পার্থক্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো। ভারতীয় রেলও সেই একই পথে হাঁটছে ভেবে আশঙ্কা করছিলেন অনেকে। যদিও পরবর্তীতে রেলমন্ত্রক থেকে জানানো হয়েছে, বেসরকারিকরণ হবে না এক্ষেত্রে। তবে, কিছু বিনিয়োগ টানার সম্ভবনা আছে। কিন্তু তাতেও কি লাভের কড়ি বুঝিয়ে দিতে গিয়ে সেই সাধারণের পকেটেই কোপ পড়বে না! তা অবশ্য আলোচনার পৃথক বিষয়।
আরও পড়ুন
অবসরপ্রাপ্তদের পুনরায় নিয়োগের পথে রেল বোর্ড, বাতিল নতুন কর্মীনিয়োগের প্রক্রিয়া
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, এই সাধারণের স্বার্থ নিয়ে আমাদের গড় ভাবনার অভিমুখটি। যতক্ষণ তা সরাসরি একটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক শ্রেণীর মানুষকে আঘাত না-করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে নিজ অপেক্ষা বিত্তনিম্ন কোনো শ্রেণীর মানুষের, এমনকি তাঁদের মৃত্যু নিয়েও বিচলিত নয়। বলা যেতে পারে, তা কোনকালেই বা ছিল! কিন্তু একেবারেই যে ছিল না, তা-ও নয়। আমাদের ধারণায়, সাধারণের বৃত্তটি বেশ প্রসারিতই ছিল। ধর্ম, জাতি, অর্থভেদে ‘অপর’ এর চিহ্নিতকরণ সাম্প্রতিক সময়ে এতটাই বেড়েছে যে, এই সাধারণ বৃত্তের মধ্যেও এখন ছোটো ছোটো বহু বৃত্তের মাথাচাড়া। যা পরস্পরকে অপর হিসেবেই বিবেচনা করছে, সেইহেতু, সময়ে-সময়ে এই অদ্ভুত উদাসীনতা আমাদের গ্রাস করছে। সিলেক্টেড আউটরেজের এই জমানায় এতখানি নির্বাচিত মূক-বধিরতা আমাদের সমাজের করায়ত্ত করার কথা ছিল কি! এই শ্রমিক বা হকাররা কি সাধারণের বৃত্তের বাইরের কেউ!
রেলের হকারদের নিয়ে আমাদের স্মৃতির উচ্ছ্বাস কিন্তু কম নয়। তাঁদের পণ্য বিক্রির নিত্যনতুন উদ্ভাবনী শক্তি, মজাদার কানভাসিং, তাঁদের শ্রম, নিত্যযাত্রীদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত- এ-সব নিয়েই আমরা সময়ে-সুযোগে গল্প করতে ভালোবাসি। কিন্তু এই দুর্দিনে তাঁদের হালহকিকত আমাদের সেভাবে প্রভাবিত করেনি। আমাদের সোশ্যাল ডিস্টান্সিং-এর প্রকল্প ভেবেও দেখেনি যে, এই অসংখ্য মানুষ কীভাবে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছেন, যখন মাসের-পর মাস ট্রেন বন্ধ। পাড়ার সবজিওয়ালার গলায় অপটু ডাক কি মাছওয়ালার হাতের আনাড়ি আঁশ ছাড়ানো দেখে যদি খটকা লাগে, যদি প্রশ্ন করা হয়, দেখা যাবে, এঁরা অনেকেই রেলের হকার। এখন বেকায়দায় পড়ে বিভিন্ন পেশা নিয়েছেন। কিন্তু তাতেও দিন গুজরান করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। কারণ, প্রত্যেকটি পেশার আলাদা ক্ষেত্র আছে; লোকজন আছে। ব্যবহারিক প্রয়োগে যাকে বলা হয়, ‘লাইন আলাদা’। যে ‘লাইনের লোক’ নয়, তার ‘লাইনে থেকে’ রুটিরুজি অর্জন মোটেও সহজ নয়। বিত্তমধ্য সমাজ এই পরিস্থিতি ও পরিণতি মেনেই নিয়েছে। মেনেই নিয়েছে যে, এর সুরাহা নেই। কেউ-কেউ অবশ্য নিজেকেই সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, সরকারি স্তরের কিছু সাহায্য তো এঁদের কেউ-কেউ পাচ্ছেন। সেই সান্ত্বনার দুধে কতটুকু জল আছে তা-ও তাঁরা বিলক্ষণ জানেন। একটা পরিবার যে কেবল কয়েক কেজি চাল কি আটায় চলে না, এ বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন কীসের!
আশ্চর্যের তবু এই যে, এত বিপুল সংখ্যক মানুষের বিপর্যয়কে তবু আমরা কিছুতেই জাতীয় বিপর্যয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারছি না। তাকে কুলুঙ্গিতে আলদা করে তুলে রাখছি। মৃণাল সেনের ছবির সেই ট্রেনের হকার, প্রিয়নাথের কথা মনে পড়ে। বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পরিস্থিতি যাঁর জীবন বিদ্ধস্ত করেছিল। আরও বেশি বিপর্যস্ত করেছিল তাঁর স্ত্রীর জীবনকে। যিনি দেখেছিলেন, অতি আপনার জনেরও স্বার্থপরতা; জীবনের ক্রূরতা; নিষ্ঠুরতা; মৃণালবাবু এই ব্যক্তিক বিপর্যয়কে, অনেকটা মিথিক্যাল রিমাইন্ডারের মতো করেই সংযুক্ত করেছিলেন, জাতীয় বিপর্যয়ের সঙ্গে; কবিগুরুর মৃত্যুদিন, সৌন্দর্যের অপমৃত্যুর সঙ্গে; সেই স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, ক্রূরতা একইরকম আছে। কিন্তু আজ সম্ভবত, এই নিরুত্তাপ সমাজ ও সময়, ‘বাইশে শ্রাবণ’ আর মেনে নিতেও রাজি নয়।
আরও পড়ুন
প্রথম বাঙালি হিসেবে রেলগাড়িতে চড়লেন রামমোহন রায়, খবর বেরোল সংবাদপত্রেও
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor