ধৈর্যই শুরুর অধ্যায়। ধৈর্যই শেষ। কথা হচ্ছে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি নিয়ে। শিকারের পিছনে দৌড়োতে থাকা চিতা, মায়ের সঙ্গে খেলতে থাকা ব্যাঘ্র শাবক কিংবা সদ্য ঠোঁটে মাছ ধরা সারসের ছবি কেবলমাত্র বিস্ময়ই তৈরি করে না। চিনতে শেখায় বন্যপ্রাণীদের জীবন। তাঁদের চলা ফেরা। তবে এই মুহূর্তগুলো চিত্রগ্রাহকরা কিনে আনেন সময়ের বিনিময়ে। যার জন্য দরকার লাগে প্যাশনের; যার জন্য বুঝতে হয় প্রকৃতির ভাষা, সংস্কৃতি। কিন্তু শুধুই কি বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনচিত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করান বন্যপ্রাণ-চিত্রগ্রাহকরা? আসলে তাঁরা আরও বড় এক কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দু। আরও বৃহৎ একটি কর্মকান্ডের প্রাণকেন্দ্র।
ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে পর্যটন শিল্প। চিত্রগ্রাহকদের তোলা ছবি দর্শকদের মধ্যে যে জঙ্গলের ব্যাপারে একটা আলাদা আকর্ষণ তৈরি করে, তা বলাই বাহুল্য। কথা হচ্ছিল সুমন কোলের সঙ্গে। যিনি শখে একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। তবে গবেষণাসূত্রে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অঙ্গাঙ্গিকভাবে। ভারতের ২০১৮-এর টাইগার সেনসাস বা ব্যাঘ্র-গণনার সঙ্গে জুড়ে আছে তাঁর নাম। ভারতে টাইগার রিজার্ভের ইতিহাস বলতে গিয়েই তাঁর কথায় উঠে আসছিল ১৯৭৩ সালের কথা। ‘প্রোজেক্ট টাইগার’ নামের একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিল তৎকালীন সরকার। তাতে উদ্বোধন করা হয় সারা ভারতে মাত্র ৯টি টাইগার রিজার্ভ। বাঘের মত রাজকীয় কোনো প্রাণীর রিজার্ভ তৈরির জন্য ব্যবস্থা করতে হয় বিপুল নিরাপত্তার। যার খরচ একপ্রকার অকল্পনীয়। ইকো-ট্যুরিজম থেকেই আসা অর্থ সেই খরচবহনে এবং উন্নয়নে অনেকটাই সাহায্য করে। কিন্তু শুরুর দিনগুলো এই রিজার্ভগুলি মূলত ছিল ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারদের আস্তানা। আর তাঁদের ছবির হাত ধরেই ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষ অভ্যস্ত হয়েছে জঙ্গলভ্রমণে। বন্যপ্রাণীদের অরণ্যজীবন চোখে দেখার স্বাদ পাওয়ার ইচ্ছে এক প্রকার তৈরি করে দিয়েছেন তাঁরাই। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। ফলে আয় বেড়েছে সরকারেরও। ১৯৭৩-এর ব্যাঘ্র সংরক্ষণের সেই সংখ্যাটাই আজ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫০-এ।
শুধু টাইগার রিজার্ভ নয়, যে কোনো ন্যাশনাল পার্ক কিংবা অন্যান্য গহীন জঙ্গলের প্রতিও টান বেড়েছে মানুষের। আর পর্যটকদের যাতায়াতে সেখানের আঞ্চলিকরা সুযোগ পেয়েছেন অন্ন-সংস্থানের। কেউ সেখানে খুলেছেন হোটেল। কেউ কাজ করছেন পর্যটকদের গাড়ির চালক হিসাবে। কেউ গাইড হিসাবে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন জঙ্গলের খুঁটিনাটি। পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্রকে এই দুর্গম, প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতে পৌঁছেছে বিদ্যুৎ, জলের সরবরাহও।
একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে, এই পরিবারগুলিতেই একসময় লেপ্টে ছিল দারিদ্র্য। ফলে খিদেকে উপেক্ষা করে শিকারের ডাক ফিরিয়ে দেওয়া কার্যত অসম্ভব ছিল অনেকের কাছেই। পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠায় আঞ্চলিক মানুষদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে সচেতনতাও। মানুষ বুঝতে শিখছে জঙ্গল রয়েছে বলেই, আসছে পর্যটক। আর সূত্র ধরেই উপার্জন জুটছে তাঁদের। ফলে তাঁরাও এক রকমভাবে এই অরণ্যের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। কেউ ছেড়েছেন শিকার। কেউ ছেড়েছেন জঙ্গলে বেআইনি কাঠ-কাটা।
আরও পড়ুন
চাকরি, দেশ ছেড়ে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে খুনসুটিতে দিন কাটাচ্ছেন ডেভ স্নাইডার
“উত্তরবঙ্গে তিস্তার ড্যামের কাছে গাজলডোবা অঞ্চলে প্রতিবছর উড়ে আসে বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। কিন্তু এই এলাকাটা কয়েক বছর আগে অবধিও ছিল একেবারেই অপরিচিত, উপেক্ষিত। অঞ্চলিক মানুষরা মূলত মাছ ধরতেন এবং পরিযায়ী পাখি মেরেই খেতেন। কিন্তু ফটোগ্রাফির সূত্রেই এখন ছবি তোলার জন্য হাজির হন অনেকে। আসেন পর্যটকরাও। ফলে সেই মানুষগুলোই পর্যটকদের নৌকায় করে নিয়ে যান পাখি দেখানো এবং ছবি তোলানোর জন্য। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গাজলডোবায় অস্বাভাবিকভাবে পাখি-হত্যা কমে যাওয়ার ঘটনার ঘটেছে কিন্তু সেই কারণেই।”
তবে বন্যপ্রাণ হত্যা কমলেও নির্মূল হয়নি একেবারেই। এই প্রসঙ্গেই সুমনবাবুর থেকে জানা গেল, যে কোনো টাইগার রিজার্ভ কিংবা জাতীয় উদ্যানের মূলত দুটি অংশ। একটি বাফার জোন। যেখানে পর্যটক প্রবেশের অনুমতি মেলে। অন্যটি হল কোর জোন বা জঙ্গলের কেন্দ্রের অঞ্চল। যেখানে প্রবেশাধিকার পান কেবলমাত্র বনদপ্তরের আধিকারিক এবং প্রতিরক্ষাকর্মীরা। টহলদারির কথা ভেবেই পুরো অরণ্যকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যেগুলিকে বলা হয় রেঞ্জ। প্রতি রেঞ্জের তত্ত্বাবধানে থাকেন একজন করে রেঞ্জার। রেঞ্জগুলি বিভক্ত থাকে আরও ছোট ছোট অঞ্চল বা বিটে। প্রতি বিটে মোতায়েন করা হয় একজন করে ফরেস্ট গার্ড এবং তার সহকারী। কিন্তু তাঁদের পক্ষে সেই বিস্তীর্ণ অঞ্চল টহল দেওয়া খুব একটা সহজসাধ্য নয়। তাঁদের সেই কাজ একদিক থেকে সহজ করে দেয় পর্যটকদের উপস্থিতিই। ফলত জঙ্গলের ‘বাফার’ এলাকায় হাজার হাজার পর্যটকদের চোখ এড়িয়ে ‘কোর’ অঞ্চলে চোরাশিকারিদের প্রবেশ করা একপ্রকার কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে বাড়তি নিরাপত্তা পাচ্ছে বন্যপ্রাণীরাও।
আরও পড়ুন
বন্যপ্রাণীদের পারাপারের জন্য বিশেষ ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনা আমেরিকায়
অরণ্যাঞ্চলে যাঁদের ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, কমেছে পশুনিধন— সেই ফটোগ্রাফারদের কাজের সঙ্গে মিশে থাকে নিষ্ঠা, ভালবাসা আর ঝুঁকি। ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারদের প্রথম এথিক্সই সেখানে বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক বিচরণে বিঘ্ন না ঘটানো। তাই কোনো একটি বিশেষ মুহূর্তকে ধরার জন্যই অপেক্ষা করতে হয় কয়েক ঘণ্টা। হয়তো দু’-তিন দিন সারাদিন অপেক্ষা করেও সেই মুহূর্ত ক্যামারেবন্দি করার সুযোগ মেলে না। তবুও ধরে রাখতে হয় ধৈর্য। যা প্রথম ও শেষ অধ্যায় ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির। সেখানে ‘পোজ’ বলে কোনো কথা নেই। রয়েছে কেবলই স্বাভাবিকতা। যা সাধারণ ফটোগ্রাফির থেকে এই কাজকে আলাদা করে দেয় একেবারেই। করে দেয় বহুগুণ কঠিন।
বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রহণ একদিক থেকে যেমন আকর্ষণীয়। তেমনই অন্যদিক থেকে বিপজ্জনকও। বিখ্যাত ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার ক্যারি উলিনস্কি’র একটি কথা একপ্রকার প্রবাদবাক্যই হয়ে গেছে। ‘ওয়াইল্ড অ্যানিমালস আর গোয়িং টু ডু হোয়াট দে আর গোয়িং টু ডু’। হ্যাঁ অবশ্যই সাফারির গাড়ি থাকে। তবে কাছ থেকে ক্যামেরা শট নিতে কিংবা গভীর অরণ্যের জীবনকে খুঁজে দেখতে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের পরে পায়ে হেঁটেই ঘুরতে হয় তাঁদের। সেক্ষেত্রে বন্যপ্রাণীর চরিত্রের ব্যাপারেও অবগত থাকতে হয়। অন্যথা ডেকে আনা নিজেরই বিপদ। সুমন কোলের কথা উঠে আসছিল এমন অনেক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথাই।
আরও পড়ুন
অভুক্ত অস্ট্রেলিয়ার বন্যপ্রাণীরা, খাবার জোগাতে প্লেন থেকে ফেলা হল আলু-গাজর
২০১৮-র ব্যাঘ্রগণনার কাজ চলছে তখন। করবেট ন্যাশনাল পার্কে একটা ক্যামেরা ট্র্যাপিং করার জন্যই বনদপ্তরের এক চৌকি থেকে আরেক চৌকির দিকে যেতে হবে তাঁকে। প্রায় দু’-আড়াই কিলোমিটার পায়ে হেঁটে। জঙ্গলের এই ‘কোর জোন’-এ অনুমতি মেলে না পর্যটকদের প্রবেশেরও। দুই ফরেস্ট গার্ড এবং সহকর্মীর সঙ্গে সেখানে ক্যামেরা লাগানোর সময়ই সুমনবাবু মুখোমুখি হন একটি হাতির। দূরত্ব ছিল মাত্র ৫০-৭০ মিটারের। প্রসঙ্গক্রমেই তিনি জানালেন, একলা হাতি হাতির পালের থেকে বেশি বিপজ্জনক হয়। পাশাপাশি ব্রিডিং সিসন হওয়ায় তাঁদের আক্রমণ প্রবণতাও থেকে বেশ খানিকটা বেশি। স্রেফ হাতিটি চলে যাওয়ার জন্যই কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁদের। মাত্র ৫০ মিটারের দূরত্ব বন্য হাতির বিচরণ রীতিমতো ভয়ঙ্কর শুনতে লাগলেও তা স্বাভাবিক ঘটনা ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারদের ক্ষেত্রে।
তবে যত উন্নত হয়েছে প্রযুক্তি। ক্যামেরা, লেন্স ততই সহজলভ্য হয়েছে মানুষের কাছে। তার দামও এসেছে সাধ্যের মধ্যে। যার ফলে দ্রুত বেড়েছে ফটোগ্রাফারের সংখ্যা। বাড়ছেও প্রতিদিন। যাঁদের মধ্যে কিছু চিত্রগ্রাহকই কেবলমাত্র পড়াশোনা করেছেন বিস্তারিত। বাকিরা স্রেফ ছবি তোলা কিংবা ভাইরাল হওয়ার ঝোঁকেই হাঁটছেন এই পথে। ছবি নকল করার প্রসঙ্গ নয় বাদই দেওয়া গেল। কতটা সতর্কতা গ্রহণ করছেন তাঁরা, সে ব্যাপারেই থেকে যাচ্ছে প্রশ্নচিহ্ন। পছন্দের ফ্রেম পাওয়ার জন্য অনেক সময় ঢিল ছুঁড়ে পাখি ওড়ানোর মত ঘটনা হামেশাই ঘটছে বিভিন্ন প্রান্তে। অনেক সংরক্ষিত অঞ্চলেও। কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে উত্যক্ত করা হচ্ছে বন্যপ্রাণীদের। হিংস্রপ্রাণীদের ক্ষেত্রে এই ঘটনায় বাড়ছে তাঁদেরই বিপদ। ঘটেছে এমন বহু দুর্ঘটনাও। অন্যদিকে বিঘ্নিত হচ্ছে বন্যপ্রাণীদের স্বাভাবিক জীবনও। অনেক সময়ই মানুষের এই আচরণে অভ্যস্ত না হওয়ায় ঠিকানা বদল করে প্রাণীরা। এই নিঃশব্দ সংঘাতের কারণে বন্ধ হয় পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনাও। একদিক দিয়ে যেমন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি বৃহত্তর অর্থে নিরাপত্তা দিচ্ছে প্রাণীদের, তেমনই কি অভিশপ্ত করে তুলছে তাদের জীবন? প্রশ্ন রইল...
ছবি ঋণ : সুমন কোলে
Powered by Froala Editor