বিড়াল, বানর থেকে কচ্ছপ— মধ্যপ্রাচ্যে চোরেদের সঙ্গী ছিল এইসব বন্যপ্রাণীরাই

আলাদিন আর আশ্চর্য প্রদীপের কিংবদন্তির কথা কার না-জানা। অ্যানিমেশন, কার্টুন থেকে শুরু করে হলিউড— সর্বত্রই নানান চেহারায় বারবার ধরা দিয়েছে আলাদিন। আর এই গল্পেরই এক আশ্চর্য চরিত্র হল ‘আবু’। না, আবু কোনো মানুষ নয়। বানর। বারবার আলাদিনের রক্ষাকর্তা হয়ে যেমন উপস্থিত হয়েছে সে, তেমনই পথে পথে চুরি করে বেড়ানো আলাদিনকেও আবু সাহায্য করত নানাভাবে। পথচলতি মানুষদের পকেট থেকে মূল্যবান জিনিস হাতিয়ে আনত পোষ্য বানরটি।

আলাদিনের কিংবদন্তি সম্পূর্ণ মনগড়া বা রূপকথা হলেও, ‘আবু’ চরিত্রটি কিন্তু নির্মিত হয়েছিল বাস্তবের ভিত্তিতেই। হ্যাঁ, মধ্যপ্রাচ্যে (Middle-East) চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িত মানুষরা সে-সময় চুরির সময় ব্যবহার করত নানা প্রজাতির পশুপাখিকে। সেই তালিকায় যেমন রয়েছে বিড়াল, তেমনই রয়েছে বানর, কচ্ছপ, পায়রা। 

হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। এইসব প্রাণীরাই সে-সময় সিঁধ কাটার সময় সঙ্গ দিত মধ্যপ্রাচ্যের চোরেদের। পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় আটশো বছর। দ্বাদশ শতকের একাধিক লেখায় উল্লেখ পাওয়া গেছে সে-কথা। ‘আবু’ চরিত্রটির বিবরণ থেকেই ধারণা পাওয়া যায় বানর কীভাবে ঘিঞ্জি লোকালয়ে কিংবা বাজারে পকেটমারদের সাহায্য করত। তাছাড়াও বড়ো কোনো ডাকাতির সময় বানরসেনা নিয়ে হাজির হত ডাকাতরা। সাধারণ বেবুন ছাড়াও সেই দলে হাজির থাকত দৈত্যাকার শিম্পাজি, বনমানুষরাও। তারাই প্রকাণ্ড প্রাসাদের বিভিন্ন মহল থেকে এনে জড়ো করত দামি দামি গ্রহরত্ন, মূল্যবান সামগ্রী। এতো গেল বানরের কথা। কিন্তু কচ্ছপ, বিড়াল কিংবা পায়রা? তারা কীভাবে সাহায্য করতে পারে চুরি-ডাকাতিতে? 

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক, গবেষক ও লেখক ক্লিফোর্ড এডমন্ড বসওয়ার্থের লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায় একটি বিশেষ তস্কর-গোষ্ঠীর কথা। চৌর্যবৃত্তি ও বন্যপ্রাণীদের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করেছিল ‘বানু সানান’ নামে পরিচিত পারস্যের এই গোষ্ঠী। তারাই প্রশিক্ষণ দিত বন্যপ্রাণীদের। কোন পরিস্থিতিতে কোন প্রাণীর ব্যবহার করা উচিত— সেটাও নির্ধারণ করত তাঁরাই। 

বসওয়ার্থের গবেষণা অনুযায়ী, কোনো বাড়িতে লোকজন আছে কিনা সে-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ব্যবহার করা হত কচ্ছপকে। দরজা ভাঙার পর কচ্ছপের পিঠে মোমবাতি বসিয়ে তা ছেড়ে দেওয়া হত ঘরের মধ্যে। সেইসঙ্গে জোরে জোরে বেশ কয়েকবার শব্দ করা হত বাইরে থেকে। তারপর কয়েক মিনিটের অপেক্ষা। ধীর গতিতে আলো পিঠে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াত কচ্ছপ। যদি সত্যিই কেউ উপস্থিত থাকতেন বাড়ির মধ্যে, তবে অন্ধকারে এই চলমান আলোর উৎস দেখে ভৌতিক ঘটনা ভেবে চিৎকার করে উঠতেন তাঁরা। তেমনটা হলে সঙ্গে সঙ্গেই চম্পট দিত চোররা। 

এই একই কাজ করত বিড়ালও। দরজার ছোট্ট ফাটল কিংবা ভাঙা জানলা দিয়ে অনায়াসেই বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ত তারা। সারা বাড়ি ঘুরে দেখত মানুষজন কেউ আছে কিনা। তারপর মিউ ডাকে সংকেত পাঠাত বাইরে অপেক্ষারত তস্কর বাহিনীকে। তবে এ তো গেল ছিঁচকে চোরের কাহিনি। এবার আসা যাক ডাকাতদের কথা। ডাকাতরা অল্প সময়ে বহু জিনিস লুঠ করতে যে বানরসেনা ব্যবহার করত— সে-কথা তো বলা হয়েছে আগেই। তাছাড়াও কোথাও কোথাও ব্যবহৃত হত হিংস্র মাংসাশী প্রাণীদেরও। পাশাপাশি সর্বদাই তাদের কাছে হাজির থাকত পায়রা। লুঠ করার পর সর্দারকে খবর পাঠানোই হোক কিংবা বাড়তি সাহায্যের জন্য বার্তা পাঠানোর কাজ— সবেতেই ব্যবহৃত হত পায়রা। 

বহু যুগ আগে থেকেই তদন্তের ক্ষেত্রে কুকুর ব্যবহার করে পুলিশ। তাছাড়াও ঈগল, ডলফিন-সহ বহু বন্যপ্রাণীকেই নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে বিভিন্ন দেশের সেনারা। তবে ভাবতে অবাক লাগে, পুলিশের কুকুর ব্যবহারের বহুযুগ আগে থেকেই বন্যপ্রাণীদের নিজেদের কাজে ব্যবহার করেছিল তাদেরই শ্রেণিশত্রু চোরেরা!

Powered by Froala Editor