এভারেস্টের নতুন নাম কেন হবে না ‘মাউন্ট শিকদার’ বা ‘মাউন্ট রাধানাথ’?

১৮৫২ সাল। উপনিবেশিক আমল। ওই সময় যদি কাউকে প্রশ্ন করা হত, বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কোনটি, তাহলে মাথা খুঁড়েও কেউ বের করতে পারতেন না এর সঠিক উত্তর। সুন্দরী-দুর্গম এক পর্বতমালার উচ্চতা মেপে বার করেছিলেন বাঙালি ভূতাত্ত্বিক রাধানাথ শিকদার (Radhanath Sikdar)। বিশ্ববাসী জেনেছিলেন, পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরের উচ্চতাকে। রাধানাথের এই পরিমাপের কাজ শেষ হয়েছিল ১৮৫৬ সালে। সেই পর্বতমালার নাম হিমালয়। যদিও এই কঠিনতম কাজ করবার পর যে স্বীকৃতি পাওয়ার কথা ছিল রাধানাথ শিকদারের, তা তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। সর্বোচ্চ শিখরের নাম হয়েছিল রাধানাথ শিকদার যে অফিসে কাজ করতেন, সেই অফিসের বড় কর্তা জর্জ এভারেস্টের নামে।

কে এই রাধানাথ শিকদার? তিনি একজন বাঙালি গণিতবিদ। আজ স্বাধীনতার ৭৬ বছর পেরিয়ে এসেও অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন, কেন মাউন্ট এভারেস্টের (Mount Everest) নতুন নাম হবে না ‘মাউন্ট শিকদার’ কিংবা ‘মাউন্ট রাধানাথ’?

কলকাতার জোড়াসাঁকো এলাকার শিকদারপাড়ায় ১৮১৩ সালের ৫ অক্টোবরে জন্মানো এই মানুষটি গণিত নিয়ে বিশেষ নাড়াচাড়া শুরু করেন। হিমালয়ের মাপজোকের একযুগেরও আগের কথা। ১৮৪০ সাল। মহা ত্রিকোণমিতিক সার্ভের কাজে অংশ নিয়েছিলেন রাধানাথ। এরও এগারো বছর পর, ১৮৫১-তে ‘ম্যানুয়াল অফ সার্ভেয়িং’ নামক এক সমীক্ষণ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর বৈজ্ঞানিক অংশটি লিখেছিলেন রাধানাথ শিকদার। তবুও একটা বিষয় অজানা ছিল তাঁর। ব্যারোমিটারে সংযুক্ত ধাতব স্কেলের তাপজনিত প্রসারণ ও পারদের নিজের প্রসারণজনিত পরিমাপের ত্রুটি, যা পাঠককে প্রভাবিত করে। সেই ত্রুটি বাতিল করার জন্য ইউরোপীয় সূত্র জানা ছিল না রাধানাথের। তবে কি থেমে যেত সবকিছু? থামবে না বলেই তাঁর বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (০ ডিগ্রি সেলসিয়াস)-এ ব্যারোমিটার পাঠ বা রিডিং কমানোর জন্য উদ্ভাবন করে বসেন নিজের সূত্র। পরবর্তীতে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল জার্নাল’-এর গবেষণাপত্রে এই সূত্রটি তিনি তুলে ধরেন। যা হিমালয় পর্বতমালার ১৫নং শৃঙ্গের উচ্চতা নিরূপণের সময়তেও হয়তো কাজে লেগেছিল। তাঁর এই মাপজোকের পরই পৃথিবীবাসী জানতে পারেন এটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ।

এরপর গ্রেট ট্রিকোনমেট্রিক সার্ভে (GTS) ঢালাও ক’রে রাধানাথ সম্পর্কে ব্রিটিশ সংসদের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। বলা হয়— ‘শুধুমাত্র উপ-সহকারী নয়, কর্তব্যনিষ্ঠ, উদ্যোগী এবং অনলস পরিশ্রমী মানুষেরা, যাঁরা জরিপ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত, নাগরিক প্রতিষ্ঠানের এমন গঠন করেছেন, যা আর কোথাও দেখা যায় না। তাঁদের সাফল্যের অংশীদার, ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা। এঁদের মধ্যে দক্ষতার জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হিসাবে, উল্লেখ করা যেতে পারে বাবু রাধানাথ শিকদারের নাম। যিনি একজন ভারতীয়, যাঁর গাণিতিক নিষ্কাশন, সর্বোচ্চ সাফল্য লাভ করেছে।’ কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল অন্য ছবি। রাধানাথ নয়, ১৮৬৫ সালে ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু স্কট ওয়ারের সুপারিশে রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটির উদ্যোগে জর্জ এভারেস্টের নামে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নামকরণ করা হয়।

আরও পড়ুন
ভূপৃষ্ঠের নিচে লুকিয়ে দৈত্যাকার পর্বতশৃঙ্গ, উচ্চতা এভারেস্ট চারগুণ!

হঠাৎই কোনও এক অজানা কারণে অদৃশ্য হয়ে গেলেন রাধানাথ। অথচ ‘ডিরোজিও বৃক্ষের উৎকৃষ্ট ফল’ এই রাধানাথ শিকদার প্রধান হাতিয়ার ছিলেন জর্জ এভারেস্টের। তাঁর কাছেই দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন রাধানাথবাবু। এমনকী ডেপুটি কালেক্টরের চাকরি নিতেও তাঁকে দেননি সার্ভেয়ার জেনারেল। যিনি একজন গণিতজ্ঞের খোঁজ করছিলেন। সেই সময় হিন্দু কলেজে পড়াশোনা করতেন ডিরোজিওর ভাবধারায় প্রভাবিত রাধানাথ শিকদার। ওই কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক জন টাইটলার জর্জ এভারেস্টের কাছে সুপারিশ করেছিলেন রাধানাথের নাম। উল্লেখ্য, মাত্র ১৯ বছর বয়সেই রাধানাথের সার্ভে অফিসে চাকরিতে ঢোকার সুযোগ হয়েছিল এভাবেই। এরপর কলেজ পাশের পর ‘গ্রেট ট্রিনোম্যাট্রিক্যাল সার্ভে’তে পাকাপাকিভাবে যোগ দিয়েছিলেন রাধানাথ। তাঁর পদের নামটি ছিল খুবই আকর্ষণীয়— ‘কম্পিউটার’। সেই প্রথম কোনও ভারতীয় এই পদে সুযোগ পেয়েছিলেন। রাধানাথের বেতন ছিল সেই সময় ৬০০ টাকা। মানুষরূপী এই ‘প্রধান কম্পিউটার’ এর পরেই শুরু করেন হিমালয়ের মাপজোক। সেই মাপজোক শেষে আনন্দে হয়তো ‘ইউরেকা’ও বলেছিলেন। কিন্তু জিওলজিক্যাল সোসাইটির উদ্যোগে জর্জ এভারেস্টের নামেই হয়ে গিয়েছিল সর্বোচ্চ শৃঙ্গের নামকরণ। এ নিয়ে পরবর্তীতে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন ১৯৩৪-এ জন্মানো ৮৬ বছর বয়সি ব্রিটিশ পর্বতারোহী ক্রিস বনিংটনও।

আরও পড়ুন
শেরপাদের ভবিষ্যৎ নেই নেপালে, ক্ষুব্ধ ২৮ বার এভারেস্টজয়ী

আজ এভারেস্টের নামকরণের ১৫৮ পরেও এই প্রশ্ন উঠছে, পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতমালার নাম কেন রাধানাথ শিকদারের নামে নয়? প্রশ্নটা না হয় আরেকটু অন্য ভাবেও করা যায়। উপনিবেশিক আমলে না হয় রাধানাথকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও বা রাধানাথকে কেন এই স্বীকৃতি দেওয়া হল না? করোনা আবহের মধ্যে একটি চিনা সমীক্ষা দল এভারেস্টের শীর্ষে পৌঁছেছিল। তারিখটা ছিল ২০২০-র ২৭ মে। দলটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম পর্বতের সঠিক উচ্চতা মাপার চেষ্টায় এভারেস্টের শিখর অবধি পাড়ি দেয়। খারাপ আবহাওয়ার কারণে মে মাসে দু’বার দেরি হয়ে যাওয়ার পর আট সদস্যের এই দল দিবাগত রাত ২.১০ মিনিটের দিকে একটি ক্যাম্প থেকে ৮,৩০০ মিটার (২৭,২৩০ ফুট) অবধি যাত্রা করে। চিনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম অনুযায়ী, প্রায় ৯ ঘণ্টা পর দলটি শীর্ষে পৌঁছয়। তারা সেখানে সমীক্ষার জন্য রেকর্ড আড়াই ঘণ্টা অবস্থান করে। সেখানে দলটি একটি সার্ভে মার্কারও স্থাপন করে। তাছাড়াও তারা একটি গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম রিসিভার ইনস্টল করে এবং তথ্য সংগ্রহের জন্য স্নো-ডেপথ র‍্যাডারও ব্যবহার করে। এটি পর্বতের বর্তমান উচ্চতা নির্ধারণের জন্য একটি বিস্তৃত বৈজ্ঞানিক সমীক্ষার অংশ। এই যে এখন এত আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োগে ‘এভারেস্ট’-এর চূড়ায় পৌঁছে বলে দেওয়া যাচ্ছে তার উচ্চতা বেড়েছে, রাধানাথের সময়ে কিন্তু বিজ্ঞান এত আধুনিক ছিল না। কেবল বিভিন্ন কৌণিক দূরত্ব অনুযায়ী উচ্চতা মেপে তার গড় নিয়ে রাধানাথ বলেছিলেন, হিমালয়ের উচ্চতা ২৯০০০ ফুট। তাই আপশোশ, যেখানে গম্ভীর অচল দিগন্ত ব্যাপী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তুষারশৃঙ্গ, তার নাম হতে পারত এক বাঙালি গণিতকারের নামে। নীল আকাশের মাঝে শুভ্র শির তুলে থাকা হিমালয় স্পর্শ করে কোনও এক পর্বতারোহী হয়তো তাঁর দেশের পতাকা উড়িয়ে স্যালুট করে আজ বলতেই পারতেন, ‘মাউন্ট শিকদারে পৌঁছিয়ে আমার স্বপ্ন সফল হল...’

Powered by Froala Editor