১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল। আকাশে চাঁদ ওঠেনি সেদিন। আটলান্টিকের বুকে আনুমানিক ১২৫ মিটার দীর্ঘ প্রকাণ্ড এক হিমশৈলের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আরএমএস টাইটানিকের (RMS Titanic)। এই জাহাজকে ‘আনসিঙ্কেবল’ হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও, প্রথম অভিযানেই আটলান্টিকে (Atlantic Ocean) ডুবে গিয়েছিল এই ঐতিহাসিক জাহাজ। প্রাণ গিয়েছিল প্রায় ১৫০০ মানুষের। তবে আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, এই জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করতে লেগে যায় আরও সাত দশক। এমনকি আজ প্রযুক্তির দুনিয়ায় দাঁড়িয়েও এই জাহাজের ধ্বংসস্তূপ যথেষ্ট দুর্গম এবং বিপজ্জনক।
গতকাল থেকেই গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে আরএমএস টাইটানিক। আর তার নেপথ্যে রয়েছে ‘টাইটানিক সাব দুর্ঘটনা’। হ্যাঁ, আজকে ১১০ বছর আগে ট্র্যাজেডির শিকার হয়েছিল যে-জাহাজ, তার মৃতদেহ দেখতে গিয়েই ফের আরও ট্র্যাজেডির শিকার হল বিশ্বের একাধিক ধনকুবের। ছোট্ট সাবমেরিনে চাপিয়ে সাধারণ মানুষকে টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপ ঘুরিয়ে দেখানোই ব্যবসা ব্রিটিশ সংস্থা ‘ওশান গেট এক্সপিডিশন’-এর। আর যাত্রীদের তার জন্য খরচ করতে হয় আড়াই লক্ষ ডলার অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় দু’কোটির বেশি টাকা। কাজেই এই অভিযান মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে। বরং, এই অভিযানে মূলত সামিল হন বিলিয়নেয়াররা। রবিবার দুই ব্রিটিশ ও এক পাকিস্তানি ধনকুবেরকে এমনই এক অভিযানে পাড়ি দিয়েছিল ২১ ফুট দীর্ঘ ‘ওশান গেট এক্সপিডিশন’-এর সাবমেরিন। তবে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। তারপর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজ এই জলযান।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনা থেকেই উঠে আসছে একাধিক প্রশ্ন। আজও কেন দুর্গম্য টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ। কী কী বিপদ লুকিয়ে রয়েছে সেখানে? কেনই-বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে মানুষ ছুটে যায় এই ধ্বংসাবশেষ দেখার জন্য?
এক এক করে উত্তর দেওয়া যাক। প্রথমত, আটলান্টিকের যে-অঞ্চলে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ শায়িত রয়েছে, তার গভীরতা সমুদ্রের উপরিতল থেকে প্রায় ৩.৮ কিলোমিটার বা ১২,৫০০ ফুট। অথচ, সূর্যালোক সমুদ্রের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে মাত্র ১ কিলোমিটার বা ৩৩০০ ফুট। ফলে, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষকে ঘিরে রয়েছে অন্ধকারের মেঘ। ‘মিডনাইট জোন’ হিসাবে খ্যাত যে-অঞ্চল। সেখানে সাবমেরিন বা অন্যান্য ডুবজাহাজ-ড্রোনের শক্তিশালী কৃত্রিম আলোও কয়েকশো মিটারের বেশি অতিক্রম করতে পারে না।
এখানেই শেষ নয়, সমুদ্রের এই গভীরতায় জলের চাপ প্রায় ৪০ মেগাপাস্কাল। অর্থাৎ, ভূপৃষ্ঠে বায়ুমণ্ডলীয় চাপের প্রায় ৩৯০ গুণ। এই প্রবল চাপ সহ্য করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করতে হয় সাবমেরিনের দেওয়াল। সেইসঙ্গে সমুদ্রের চোরাস্রোত তো রয়েইছে। সমুদ্রের উপরিতলের সমুদ্রস্রোতের থেকে এই স্রোতের গতি কম হলেও, জল ঘনত্ব বেশি হওয়ার কারণে তা আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যে-কোনো জলযানের ক্ষেত্রেই। বিশেষ করে সমুদ্রগর্ভ অর্থাৎ ধ্বংসাবশেষের একদম কাছে এই স্রোতের সঙ্গে মিশে যায় গাঢ় পলি। ‘থার্মোহালাইন স্রোত’-খ্যাত এই পলির তরঙ্গ ভেদ করে যেমন ছোটো সাবমেরিনের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কঠিন, তেমনই এই স্রোতের দরুন দৃশ্যমানতাও সীমিত হয়ে যায় কয়েক মিটারের মধ্যে। ফলে ধ্বংসাবশেষে আঘাত লাগার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে প্রবলভাবে। কারণ, মূল জাহাজ ছাড়াও, জাহাজের বিভিন্ন আসবাব ও অংশের ভগ্নচিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়েই।
অথচ, এই বিপদ, জীবনের ঝুঁকিকে পরোয়া না-করেই বহু মানুষ প্রতিবছর পাড়ি দেন অতলান্তিক মহাসাগরে। তা শুধুই কি অ্যাডভেঞ্চারের নেশা? না। আসলে আটলান্টিকের নিচে টাইটানিকের শেষ চিহ্নটুকুও আর কয়েক দশকের মধ্যেই সম্পূর্ণভাবে চাপা পড়ে যেতে পারে পলিতে। সময়ের এই নিজস্ব ধারাকেই ব্যবসার ইউএসপি তথা বিজ্ঞাপনের অন্যতম হাতিয়ার করে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট পর্যটন সংস্থাটি। আর ইতিহাসের এই আশ্চর্য অধ্যায়কে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতেই তাই এই ‘ফাঁদে’ পা দিয়ে চলেছেন বহু মানুষ। প্রশ্ন থেকে যায়, এই ট্র্যাজেডির পরেও কি বন্ধ হবে ‘টাইটানিক পরিদর্শন’-এর এই ব্যবসা? বা প্রণীত হবে নতুন কোনো আন্তর্জাতিক আইন? উত্তর দেবে সময়।
Powered by Froala Editor