আমেরিকায় রুমির জনপ্রিয়তার কারণ কী?

তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে থেকে নিউ ইয়র্কের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কিলোমিটার। তবে দক্ষিণ-পূর্ব মধ্য এশিয়ার দেশটির এক কিংবদন্তির কবিতা বা সংগীত এই দূরত্ব ঘুচিয়েছে। আমেরিকায় জালালুদ্দিন মহম্মদ রুমির (Jalal al-din Muhammad Rumi) জনপ্রিয়তা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুফি কিংবদন্তি রুমি ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর  তাজিকিস্তানের (Tajikistan) এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রুমির জন্মের ৮০০ বছরেরও বেশি সময় পরেও আমেরিকায় তাঁর রুবাই ও গজলের বইয়ের লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হচ্ছে।

রুমির অন্যতম জীবনীকার আমেরিকান লেখক ব্র্যাড গুচ লিখছেন, তাঁর প্রভাব সমস্ত সংস্কৃতিতেই। রুমির জীবনী লেখার জন্য গুচ বহু দেশ ঘুরেছেন। সেসব দেশে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে রুমির প্রভাব রয়েছে। আসলে, রুমির জীবন ২৫০০ মাইল দীর্ঘ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। রুমির জন্ম তাজিকিস্তানের ভাখশ গ্রামে। এর পরে তিনি উজবেকিস্তানের সমরকন্দ, তারপর ইরান ও সিরিয়ায় যান। যৌবন কাটিয়েছেন সিরিয়ার দামেস্কে। আলেপ্পোতে শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন। জীবনের ৫০ বছর তুরস্কের কোনিয়াকে থেকেছেন। এখানেই প্রয়াত হন রুমি। প্রতি বছর ১৭ ডিসেম্বর, রুমির সমাধিতে তাঁর গুণমুগ্ধদের (বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানসহ) সমাবেশ হয়। রুমির মৃত্যুবার্ষিকীতে দরবেশ ঐতিহ্যের এই অনুষ্ঠানে সারাবিশ্বের মানুষ আসেন।

রুমির জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ১২৪৪ সালে। এই সময় তিনি সুফি সাধক শামস তাবরিজির সঙ্গে দেখা করেন। গুচের ব্যাখ্যা, রুমির বয়স তখন ৩৭। তাঁর বাবা ও দাদার মতো তিনিও একজন মুসলিম ধর্মীয় শিক্ষক এবং পণ্ডিত ছিলেন। রুমি এবং তাবরিজির মধ্যে তিন বছরের বন্ধুত্ব রুমিকে সুফির রঙে রাঙিয়েছে। তবে শামস তাবরেজি তিন বছর পর হঠাৎ নিখোঁজ হন। কবিতায় নিমগ্ন হয়ে পড়েন রুমি। হয়ে ওঠেন সুফি।

রুমি প্রায় সব লেখাই ৩৭ থেকে ৬৭ বছর বয়সের মধ্যে। শামস, নবী মহম্মদ এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর ভালোবাসা প্রকাশ করে প্রায় তিন হাজার গান লিখেছেন তিনি। এ ছাড়াও তাঁর লেখা রুবাইয়ের সংখ্যা দু-হাজার। চার লাইনে লেখা হয় রুবাই বা রুবাইয়াৎ। ছ-খণ্ডের আধ্যাত্মিক মহাকাব্য মসনবী বা মসনবী-ই মা'নবীও রচনা করেছিলেন। রুমির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সুলতান ওয়ালাদ ও তাঁর অনুসারীরা 'মৌলভী ক্রম' স্থাপন করেন। একে ঘূর্ণায়মান দরবেশও বলা হয়। সুফি-নৃত্যে যা 'সামা'।

আরও পড়ুন
রাখি পরালেই দিতে হবে টাকা, কবি মহাদেবী বর্মার কাছে আবদার আরেক কবির

নরোপা ইউনিভার্সিটির জ্যাক কেরোয়াক স্কুল অফ ডিসেমবডিড পোয়েটিক্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা কবি অ্যান ওয়াল্ডম্যান বলেছেন, 'যখন আমরা সুফি ঐতিহ্য, পরমানন্দ এবং ভক্তিবাদের বাইরে গিয়ে তাঁর কবিতাগুলি অনুভবের চেষ্টা করি, তখন একজন গভীর রহস্যময় কবি হিসাবেও রুমিকে পাই।' কাব্যতত্ত্বের অধ্যাপক অ্যান ওয়াল্ডম্যান বলেছেন, সম্প্রীতির ঐতিহ্যও তাঁর কাছ থেকে উৎসাহিত। আমেরিকার ন্যাশনাল লাইব্রেরি সিরিজেও জায়গা পেয়েছেন রুমি। প্রকল্পটির সহ-স্পন্সরিং পোয়েটস হাউসের নির্বাহী পরিচালক লি ব্রিকেটি বলেছেন, 'সময়, স্থান এবং সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রুমির রুবাই আজও জীবন্ত। তাঁর কাজ আমাদের সেই অনুসন্ধানকে বুঝতে সাহায্য করে, যা প্রেম এবং পরমানন্দের সঙ্গে জুড়ে।' ব্রিকেটি সৌন্দর্য এবং প্রেমের অনুরণনের ক্ষেত্রে রুমির রচনাকে শেকসপিয়রের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

আরও পড়ুন
কাশ্মীরে বিপন্নপ্রায় ফার্সি, সংরক্ষণের হাতিয়ার কবির পাণ্ডুলিপি

আমেরিকান কবি কোলম্যান বার্কস রুমির রচনা অনুবাদ করেছেন। এই কাজের জনপ্রিয়তা রুমির কবিতাকে আমেরিকায় সর্বাধিক বিক্রিত কবিতায় পরিণত করেছে। তাঁর মতে, 'রুমিকে পড়ার সময় মনে হয় যেন তা যেন আমাদের ভেতর থেকেই উঠে আসা।' কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এজে আরবেরি রুমির রচনাগুলির অনুবাদ করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে কোলম্যান বার্কসকে আমেরিকান কবি ও প্রাবন্ধিক রবার্ট ব্লাই আরবেরির অনুবাদগুলি দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, বার্কস একজন আমেরিকান কবি। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সাহিত্য অনুষদও। যদিও তিনি ফার্সি বলতে বা পড়তে জানতেন না। রুমির একজন জনপ্রিয় দোভাষী এহেন বার্কস। ইংরেজি অনুবাদের উপর ভিত্তি করে রুমির কবিতা পুনর্লিখন করেছেন। ব্লাই বার্কসকে বলেছিলেন, 'কবিতাগুলিকে তাদের খাঁচা থেকে মুক্তি দেওয়া দরকার।' বার্কস তখন অ্যাকাডেমিক অনুবাদটিকে সাধারণ আমেরিকান ইংরেজিতে রূপান্তরিত করেন।

৩৩ বছরে ২২টি খণ্ডে রুমির রচনা অনুবাদ করেছিলেন বার্কস। এর মধ্যে রয়েছে 'দ্য এসেনশিয়াল রুমি', 'এ ইয়ার উইথ রুমি', 'রুমি: দ্য বিগ রেড বুক', 'দ্য ড্রোনড বুক' প্রভৃতি। বইগুলোর প্রকাশক হারপারওয়ান। সবমিলিয়ে বইগুলির ২০ লক্ষেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। ২৩টি ভাষায় অনূদিতও হয়েছে এইসব গ্রন্থ। রুমির জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বার্কস বলেন, 'আমি মনে করি সর্বধর্ম নির্বিশেষে রুমিকে নিয়ে সারাবিশ্বে একটি আন্দোলন চলছে। এর পেছনের কারণ সাম্প্রদায়িক হিংসার অবসান ঘটানো এবং ধর্ম থেকে ধর্মকে আলাদা করে এমন দেওয়াল সরিয়ে ফেলা। কথিত আছে, ১২৭৩ সালে রুমির সমাধিতে সকল ধর্মের মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন। কারণ তিনি সকলের বিশ্বাসকে মনুষ্য ধর্মের পথে চালনা করেছিলেন।’

রুটগার্স ইউনিভার্সিটির মধ্যযুগীয় সুফিবাদের পণ্ডিত জাভেদ মোজাদ্দেদির মতে, রুমির রচনা পাঠকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে। পাঠকদের শিখিয়েও নিতে পারে। রুমির তৃতীয় বিশেষ বিষয় হল তাঁর কল্পনাশক্তি। চতুর্থত, সুফি ঐতিহ্য প্রেমের মিলনের অপ্রাপ্যতা এবং প্রেয়সীর প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণার উপর জোর দেয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে সর্বশক্তিমানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই এই মতবাদের মর্মকথা। আধ্যাত্মবাদ অতীন্দ্রিয়বাদ বা রহস্যবাদই এর শিকড়। রুমি একে উৎসবের মতো উদযাপন করেছেন।' মোজাদ্দেদি রুমির শ্রেষ্ঠ রচনা মসনবীর ছ'টি খণ্ডের তিনটি অনুবাদও করেছেন। রুমির মসনবী হল একক কবির লেখা ২৬ হাজার পদের দীর্ঘতম আধ্যাত্মিক কাব্য। মোজাদ্দেদির দৃষ্টিতে রুমির মসনবী কুরআনের পরে ইসলামি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনা।

Powered by Froala Editor